Editorial News

এমন আরও অনেক আমডাঙা বোধ হয় অপেক্ষায়

পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আমডাঙায় অশান্তি হয়েছে। নির্বাচনের দিনে অশান্তি হয়েছে। বোর্ড গঠনের আগে রক্তস্রোত বয়ে গেল। শবের মিছিল যেন এক রাতেই।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২০
Share:

দলীয় স্বার্থে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক কাঠামোকে নস্যাৎ করা আমাদের রাজনীতির একটা অমোঘ প্রবণতা যেন। তার ফলটা কী দাঁড়ায়, প্রমাণ দিচ্ছে আমডাঙা। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই, পুলিশ সর্বত্র ঢুকতে পারছে না। কোনও রাজনৈতিক দল বুক ঠুকে বলতে পারছে না, আমডাঙা তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আগ্নেয়াস্ত্র আর বিস্ফোরকের ত্রাস। পুলিশ তথা আইন-শৃঙ্খলারক্ষী বাহিনী এখন খুব তৎপর। রাজনৈতিক দলগুলিও বার বার বলছে, শান্তি ফিরুক। তবু স্বাভাবিকতা ফিরছে না সহজে। উত্তর ২৪ পরগনার গ্রামীণ জনপদটা যেন নিশ্চুপে বলছে, এই প্রশাসনিক তৎপরতা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বার্তাটা এখন এসে লাভ নেই। আরও আগে আসা জরুরি ছিল।

Advertisement

পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আমডাঙায় অশান্তি হয়েছে। নির্বাচনের দিনে অশান্তি হয়েছে। বোর্ড গঠনের আগে রক্তস্রোত বয়ে গেল। শবের মিছিল যেন এক রাতেই।

শুধু পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে থেকে বা পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে আমডাঙা উত্তপ্ত হল, এমনটা ভাবলে অবশ্য খুব ভুল হবে। যে কাণ্ড ওই এলাকায় ঘটে গেল, তা সাংবিধানিক কাঠামোর উপরে দীর্ঘকাল ধরে ক্রমাগত আঘাতের ফল, পুলিশ-প্রশাসনের অনবরত দলদাসত্বের ফল। আইনের শাসন একটু একটু করে মুছতে মুছতে আমডাঙা এ বার নৈরাজ্যের গ্রাসে, আমডাঙা আজ দুষ্কৃতী দাপটে রক্তাক্ত।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

শুধু আমডাঙাই অশান্ত, এমনটা ভাবলেও খুব ভুল হবে। অশান্তির আগুন ধিকি ধিকি সর্বত্র। কারণ সাংবিধানিক কাঠামোর সংহারের প্রক্রিয়াটা শুধু আমডাঙায় সীমাবদ্ধ নয়। দিনহাটা থেকে সবং, কাটোয়া থেকে কাকদ্বীপ, নানুর থেকে নারায়ণগড়, বালুরঘাট থেকে ইসলামপুর, মানিকচক থেকে তেহট্ট, আসানসোল-দুর্গাপুর থেকে আরামবাগ-গোঘাট, ডোমকল-কান্দি-বেলডাঙা থেকে ভাঙড়-বামনঘাটা-রাজারহাট— সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙেচুরে তছনছ করাটা সর্বত্র সমানে চলেছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, দশকের পর দশক। আজ পরিস্থিতির রাশ হাতের বাইরে যাওয়ার পথে। বারুদের স্তূপ হয়ে রয়েছে যেন প্রত্যেকটা প্রান্ত। আমডাঙায় বিস্ফোরণটা সর্বাগ্রে ঘটে গেল। অন্য যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও দিন, যে কোনও সময়ে একই রকম বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

আরও পড়ুন
‘রাস্তায় অস্ত্র রেখে যান, পুলিশ নিয়ে যাবে’, আমডাঙাকে আহ্বান জ্যোতিপ্রিয়র

রাজনীতিকে ক্রমাগত সঙ্কীর্ণতার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নীতি বা আদর্শের বালাই নেই, শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকাই লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। পুলিশ-প্রশাসনকে শাসক দল দাসানুদাসে পরিণত করতে চেয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও মসৃণ ভাবে তেমনটা ঘটতে দিয়েছেন, সহজেই দাসত্ব স্বীকার করেছেন। ফলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে দিনের পর দিন। রাষ্ট্রের সক্ষমতা এবং সদিচ্ছা নিয়ে নাগরিকের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রশাসনে আস্থা উবে গিয়েছে। পুলিশকে দেখে শত্রু মনে হয়েছে। অর্থাৎ এক বিরাট অংশের নাগরিকের মননে দিন দিন গোটা ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা বেড়েছে। নাগরিক মননে রাষ্ট্রের ছবিটা অনেক সময় সম্ভবত এক সংগঠিত নৈরাজ্য হিসেবে ধরা দিয়েছে। তাই আজ নৈরাজ্য দিয়েই তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

আমডাঙায় যা ঘটেছে, তাকে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। বোমা-গুলি-বন্দুক কখনও গণতান্ত্রিক রাজনীতির অঙ্গ হতেই পারে না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোয় হিংসার কোনও স্থানই থাকতে পারে না। যা ঘটেছে, তার দ্ব্যর্থহীন নিন্দাই বাঞ্ছনীয়। আর কিছুতেই যেন এমন না ঘটে,তা নিশ্চিত করাও কর্তব্য। কিন্তু নিশ্চিত করবে কে? নিশ্চিত করার কথা যাঁদের, তাঁরা কি আদৌ গণতন্ত্র বা সংবিধানের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা পালন করেন?

গণতন্ত্রে বাস করছেন বলে নাগরিক কি বিশ্বাস করছেন আদৌ? নাগরিকের অধিকারকে সুনিশ্চিত করার জন্য একটা সাংবিধানিক কাঠামো রয়েছে এবং সেই কাঠামো অনুযায়ীই সবটা হচ্ছে— এমনটা কি মনে হচ্ছে নাগরিকের? প্রশ্নগুলোর জবাব এ বার বোধ হয় না খুঁজলেই নয়।

আমাদের প্রত্যেকের উচিত প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হওয়া। নিজেদের কাছেই উত্তর চাওয়া। রাজনীতিক বা প্রশাসনিক কর্তা বা সংবিধান রক্ষায় দায়বদ্ধ অন্য যে কেউ— প্রত্যেকের উচিৎ আয়নার সামনে দাঁড়ানো। ভূমিকায় গলদ রয়েছে কি না, তা দেখার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। গলদ যে রয়েছে তা আমডাঙাই বুঝিয়ে দিয়েছে। গলদটা ঠিক কোথায় এবং গলদের পরিমাণ কতটা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটাই খতিয়ে দেখা দরকার। এখনও যদি আত্মবিশ্লেষণ না করে দায়বদ্ধ পক্ষগুলো, নৈরাজ্যের গ্রাস আরও করাল হতে দেরি নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন