এ-বার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। ছবি: পিটিআই।
ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে সে দিন এক অর্থনীতিবিদ আমলা জমাটি আড্ডায় বলে উঠলেন, ‘‘ডিমিনিশিং মার্জিনাল ইউটিলিটি কাকে বলে জানেন?’’ আমি বললাম, ‘‘ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগিতার মানে সম্ভবত বুঝি। প্রথম রসগোল্লাটা খেয়ে তৃপ্ত। তার পরে আরও কয়েকটা খেলাম। যত খাচ্ছি ততই প্রান্তিক উপযোগিতা কমতে থাকে।’’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে সেই রাশভারী প্রবীণ আমলা বললেন, ‘‘ঠিক বলেছেন। আমাদের নরেন্দ্র মোদীর প্রান্তিক উপযোগিতাও কমতির দিকে।’’ ভদ্রলোক মোদী-বিরোধী বলে পরিচিত নন। অনেক বইটইও লিখেছেন। দার্জিলিং সেকেন্ড ফ্লাশ চায়ে চুমুক দিয়ে পাশে বসা মহিলা কূটনীতিক বললেন, ‘‘আমি নিশ্চিত নই, দার্জিলিং-এর চা বলে আমরা সকলে এখন যা পান করছি সেটি আসলে দার্জিলিং-এর, না কি মেড ইন নেপাল! কিন্তু এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, মোদীর ভাবমূর্তির অবক্ষয় দ্রুত জন্ম দিচ্ছে রাহুল গাঁধীর পরিসরের।’’
রাহুল গাঁধী?
মুহূর্তের জন্য আমাদের বৈকালিক আড্ডায় ‘গর্ভবতী নিস্তব্ধতা’। মহিলা কূটনীতিকের মন্তব্য শুনে মনে পড়ল, ঠিক এ ভাবেই শেষের কবিতায় অমিত রায় এক দিন জনতার সরণিতে নিবারণ চক্রবর্তীর নাম, পরিচিতি পেশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ফজলি আম ফুরালে ফজলিতর আম আনতে বলব না। বলব, বাজারে ওঠা নতুন আতা নিয়ে এসো। রাহুল আনকোরা অপরিচিত ব্যক্তিত্ব নন। কিন্তু আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি এক নতুন অবয়ব নিয়ে সকলের অজান্তে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
গত কয়েক বছর ধরে প্রচার চলছে। তিনি সনিয়া মায়ের এক অবোধ শিশু। তাঁর রাজনীতিতে শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা। ভারতের রাজনীতির ‘জমিনি হকিকত’ থেকে সহস্র যোজন দূরে। নন-সিরিয়াস। বিদেশে ঘুরে বেড়ান। রিলাকটান্ট রাজনীতিবিদ। দায়িত্ব গ্রহণে ভীত। সংসদে আসেন না। এলেও পিছনের আসনে বসে ঘুমিয়ে পড়েন। প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মধুর নয়। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান। বাগ্মী নন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারে বিজেপি বাহিনী এহেন প্রচার চালাচ্ছে লাগাতার। আগেকার দিনে গ্রামীণ সমাজে স্রেফ গুজবের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা যেত। তবে সভা করে তার বিহিত করার একটা ব্যবস্থা ছিল। এখন মিডিয়াশাসিত যুগে জনগণের ‘ধারণা’ই শেষ কথা। হতে পারে
সেটা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। কিংবা পোস্ট-ট্রুথ। হতে পারে আমাদের আচ্ছন্ন চেতনা বাস্তবতাকে সরিয়ে তাকেই পুজো করে। এত কাণ্ডের পরেও একটি সংবাদপত্রের করা সমীক্ষা বলেছে, শতকরা প্রায় ৯৪ ভাগ মানুষ এখনও রামরহিমের ভক্ত। তাঁরা রামরহিমের মুক্তি চান!
বিজেপি-র শীর্ষ নেতারা প্রায়ই একান্ত আলোচনায় আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনার অসন্তোষের কারণ বুঝলাম। কিন্তু বিরোধীদের বিকল্প নেতাটি কে? রাহুল গাঁধী? তাঁকে তো মমতাদিদিই মানবেন না! তিনি নিজেই তো প্রধান কান্ডারি হতে চাইবেন।’’ বিজেপি-র এই নেতারা জানেন না কিংবা মানতে চান না, ভারতের রাজনীতিতে অতীতে বার বার এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর পরিস্থিতিই নতুন মুখ, নতুন নেতার জন্ম দিয়েছে।
মমতা নিজেও বিজেপির কৌশল সম্পর্কে অবহিত। সনিয়া এবং রাহুলের সঙ্গে তাই তিনি শুধু ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাই করেন না, তাঁদের বলেছেন, যাতে ‘‘বিজেপি-র ফাঁদে আমরা কেউ পা না দিই। আপাতত সব ভুলে রাজ্যে রাজ্যে মোদী সরকার বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঠিক করাটা প্রাথমিক কাজ নয়।’’
ভারতের মতো এক বিশাল যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে নানা রাজ্যে নানা আঞ্চলিক দলের দাপট রয়েছে। সর্বত্রই শাসক-বিরোধী রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হচ্ছে। অমিত শাহকে কৃতিত্ব দিতেই হবে যে তিনি আসার পর যে সব রাজ্যে বিজেপি নেই সেখানেও বিজেপির জয়পতাকা ওড়ানোর এক প্রবল প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। বিজেপি-র অর্থবল, বাহুবল রয়েছে। আছে অমিত শাহের মতো চাণক্যের কৌশল। তবুও, এ সবের মধ্যেও, কেন রাহুল?
ধীরে ধীরে রাহুল-বিরোধী প্রচারের বদলে সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদীবিরোধী প্রচার শুরু হয়েছে। সে বুলেট ট্রেনই হোক বা নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। দেশবিদেশের সংবাদমাধ্যমে সে সব নিয়ে রঙ্গ রসিকতা কিছু কম হচ্ছে না। ৫৬ ইঞ্চি ছাতি অথবা মন কি বাত নিয়ে বিরোধীরা যে খুব পরিকল্পিত ভাবে মাঠে নামতে পেরেছেন তা নয়। বরং কংগ্রেসের মিডিয়া সেল এখনও বিজেপির মিডিয়া সেলের কাছে রোজ ১০ গোল খায়। তবু, ওই ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগিতার কারণেই, তৈরি হচ্ছে এক নতুন রাজনৈতিক পরিসর। পশ্চিমবঙ্গে মমতা অথবা তামিলনাড়ুতে স্তালিন থাকতেই পারেন। কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে, বিশেষত হিন্দি বলয়ে এখনও বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। আর সেই পরিসরের প্রধান নায়ক হয়ে উঠছেন রাহুল গাঁধী। রাহুলের বিদেশ যাওয়া নিয়েও দৃশ্যপট হঠাৎই বদলে গিয়েছে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাহুলের অন্তরঙ্গ কথোপকথনে মুগ্ধ অনেকেরই ধারণা, রেটরিক বা অপটিক্স নয়, তিনি সত্যি কথা বলতে চাইছেন। ভারতের নাগরিক সমাজের কাছেও এক ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারতের প্রত্যাশা নতুন করে তৈরি করছেন তিনি। বিজেপি রাহুলের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ করেছেন। কিন্তু মোদী জমানায় এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, কোনও মন্ত্রী বা নেতা নন, সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক মোদী এবং অমিত শাহ জুটি। কংগ্রেসে যে আজও গণতন্ত্র বিজেপির চেয়ে বেশি, তার প্রমাণ, রাজস্থানে গহলৌত না সচিন পাইলট— কে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হবেন তা নিয়ে এখনও দলে আলোচনা চলছে।
মানতেই হবে, মোদী রাহুলের চেয়ে বেশি বাক্পটু। কিন্তু গত তিন বছর ধরে সারাক্ষণ সর্বত্র তাঁর ছবি দেখতে দেখতে এক অতিপ্রচারের সমস্যা এসেছে। রবীন্দ্রনাথ এক বার বলেছিলেন না, ভাল জিনিসটা পৃথিবীতে কম হয় বলেই তা ভাল! তিন বছর ধরে সকাল বিকেল সন্ধ্যা মোদীর এত ভাল ভাল ঘোষণা দেখে তাই ভারতের জনসমাজে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে।
বোধহয় মোদীও সেটা বুঝতে পারছেন। তাই তিনি এখন বলছেন, ‘ভোটের রাজনীতি আমার লক্ষ্য নয়। উন্নয়নই লক্ষ্য।’ হাততালি। বলছেন, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমার লক্ষ্য। হিন্দু মুসলমান কোনও ভেদ নেই।’ হাততালি। মোদী বলছেন, ‘আমি শিলান্যাস করি সেই প্রকল্পের, যেটা আমি উদ্বোধনও করি।’ হাততালি। মোদী বলছেন, ‘মন কি বাত আমার মনের কথা নয়। মানুষের মনের কথা।’ হাততালি হাততালি। কিন্তু মানুষ এ বার এই মেকি বাস্তবতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইছে মাটির মানুষ।
দেশের বহু মানুষ মনে করছেন, প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। অনেকে ক্ষমতার মোহে দেখতে পাচ্ছেন না।