নারী

সহজ কথায়, মেয়েরা নিজেদের জোরে যতখানি যোগ্যই হউন না কেন, সমাজের চক্ষে গ্রহণযোগ্য হইবার জন্য তাঁহাদের ‘মেয়ে’ হইয়া উঠিতে হয়। পুরুষতন্ত্রের সংজ্ঞা যাহাকে ‘মেয়ে’ বলে, তাহাই। অবশ্য, তাঁহারা তো তবু মানুষ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

শেষ অবধি বিড়ালটি বাহির হইল। টেনিস কোর্টে তাঁহার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী সেরিনা উইলিয়ামস সম্বন্ধে মারিয়া শারাপোভা যে মন্তব্যগুলি করিয়াছেন, তাহার মূল কথা ‘বডি শেমিং’— কাহারও দেহাবয়ব লইয়া খোঁটা দেওয়া। সেরিনার শরীর পেশিবহুল। মারিয়া কটাক্ষ করিয়াছেন, সেরিনার পুরুষদের কোর্টে খেলা উচিত ছিল। তাঁহাদের দ্বৈরথ দীর্ঘ দিনের, এবং টেনিস কোর্টে সেরিনা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অতএব, কেহ ভাবিতেই পারেন, কোর্টে যাহা পারেন নাই, বইয়ের পাতায় মারিয়া সেই প্রতিশোধ লইলেন। শুধু মারিয়ার হীন রুচির নিন্দা করিয়া থামিয়া গেলে আসল প্রশ্নটি অধরা থাকিয়া যায়। এত কথা থাকিতে সেরিনার শারীরিক গঠনের প্রসঙ্গটিই আসিল কেন? তাঁহার শরীরে পেশির বাহুল্য আংশিক ভাবে বংশগতির ফল, আর অংশত পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত। কোনওটিই কি তাঁহার নারীত্বকে অস্বীকার করিতে পারে? এইখানেই আসল কথা— পুরুষতন্ত্র নারীত্বের যে সংজ্ঞা স্থির করিয়া দিয়াছে, সেখানে পেলবতা গ্রাহ্য, পেশি নহে। তাহার উপর সেরিনা জাতিগত ভাবে আফ্রিকান, অতএব কৃষ্ণাঙ্গী। যে নারীর গাত্রবর্ণ কালো, এবং যাঁহার শরীরে পেশি ঢেউ খেলিয়া যায়, তাঁহাকে পুরুষতন্ত্র ‘নারী’ হিসাবে স্বীকার করিতে চাহে না। কারণ, পুরুষতন্ত্র নারীকে মূলত যৌন আবেদনের মাপকাঠিতে মাপে— তাহার ভঙ্গুর ভাব, পুরুষের তুলনায় তাহার শারীরিক ক্ষীণতাই তাহাকে আকর্ষক করিয়া তোলে। সেরিনা বাহ্যিক ভাবে সেই ‘নারীপ্রতিমা’ হইতে বহু আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করেন। পুরুষতন্ত্রের চক্ষে, অতএব, তাঁহার নারীত্ব অগ্রাহ্য। মারিয়া শারাপোভা পুরুষতন্ত্রের বুলি আওড়াইয়া ফেলিয়াছেন।

Advertisement

পৃথিবীর যে প্রান্তে তাঁহাদের বাগ্‌যুদ্ধ চলিতেছে, তাহার বহু দূরের এক অঞ্চলের হাওয়ায় এখন উৎসবের গন্ধ। দেবীর আরাধনার উৎসব। পুরুষ দেবতারা যে অসুরকে দমন করিতে পারেন নাই, তাহাকে মারিবার জন্যই দেবীর সৃষ্টি। যে জাতি দেবীর আরাধনা করে, সে জাতির নারীও কি সর্ব ক্ষণ ‘বডি শেমিং’-এর শিকার নহে? যে কন্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম হয়, যে মেয়েটি খেলিয়া বিশ্বজয় করে, যে মহিলা এক হাতে সংসারের সমস্ত কাজ সামলাইতে থাকেন, যে নারী অফিসে-আদালতে-ঘরে-বাহিরে পুরুষের তুলনায় সর্বার্থে যোগ্যতর হইবার প্রমাণ দেন, তাঁহাদেরও কি শেষ অবধি মাপা হয় না তাঁহাদের গাত্রবর্ণ, চুলের বাহার, স্তন-কটি-নিতম্বের পরিসংখ্যানে? টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন প্রমাণ দিবে। অতিযোগ্য মেয়েটিকেও শেষ অবধি ফরসা হওয়ার মলমের শরণাপন্ন হইতে হয়, নচেৎ তাহার যোগ্যতার দাম মিলে না বাজারে। সহজ কথায়, মেয়েরা নিজেদের জোরে যতখানি যোগ্যই হউন না কেন, সমাজের চক্ষে গ্রহণযোগ্য হইবার জন্য তাঁহাদের ‘মেয়ে’ হইয়া উঠিতে হয়। পুরুষতন্ত্রের সংজ্ঞা যাহাকে ‘মেয়ে’ বলে, তাহাই। অবশ্য, তাঁহারা তো তবু মানুষ। পুরুষতন্ত্র দেবীকেও ছাড়ে নাই। মহিষাসুরমর্দিনীকেও ফর্সা, কেশবতী, সুস্তনী, গুরুনিতম্বিনী হইতে হইয়াছে। তিনি সফল, তিনি অরিজিতা। কিন্তু, তাঁহার সেই সাফল্যের ছবিটিকে পুরুষতন্ত্র তাঁহাকে ‘মেয়ে’ হিসাবেই আঁকিয়াছে। দুর্গাকে সেরিনা উইলিয়ামস রূপে কল্পনা করিতে হইলে পুরুষতন্ত্র সম্ভবত মারিয়া শারাপোভার ভাষাতেই আঁতকাইয়া উঠিবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন