হার্দিক পটেল। —ফাইল চিত্র।
প্রতিহিংসার ছাপ বেশ স্পষ্ট। পতিদার সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণের দাবিতে গুজরাতে আন্দোলন সদ্য শুরু হল, এমন নয়। নতুন করে উত্তপ্ত হয়েছে পরিস্থিতি, তেমনও নয়। তা সত্ত্বেও জারি হয়ে গেল জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা। কার বিরুদ্ধে? আর্থ-সামাজিক মাপকাঠিতে তথা ভোটের রাজনীতিতে গুজরাতে সবচেয়ে প্রভাবশালী যাঁরা, সেই পতিদারদের জন্য সংরক্ষণের দাবিতে লড়তে থাকা তরুণ হার্দিক পটেলের বিরুদ্ধে। ভোটের রাজনীতি বিজেপি বোঝে না, এ কথা কোনও অরাজনৈতিক ব্যক্তিও বলবেন না। তাই বিজেপি শাসিত রাজ্যে ভোটের মুখে পতিদার নেতার নামে সহজেই জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে যাবে, এ-ও বিশ্বাস করা খুব শক্ত। সব মহলই তাই কারণটা খুঁজে বার করতে চাইছেন। আর কারণটা খুঁজতে গেলেই প্রতিহিংসার তত্ত্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: কংগ্রেস ঘনিষ্ঠতার জল্পনা শুরু হতেই জামিন অযোগ্য পরোয়ানা হার্দিকের নামে
গুজরাতের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন মর্যাদার লড়াই বিজেপির জন্য। গোটা দেশে যখন গেরুয়া ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন দুই গুজরাতি নেতা, তখন গুজরাতের নির্বাচনে ফল ভাল হওয়া বিজেপির জন্য আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন গুজরাতের মসনদ বিজেপি-র হাতে। অতএব ক্ষমতা-বিরোধিতার হাওয়াকেও সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যাচ্ছে না। নির্বাচনের আগে তাই অস্বস্তি কিছুটা থাকছেই মোদী-শাহের শিবিরে। এমন এক পরিস্থিতিতে বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো যদি মাথা তোলেন হার্দিক পটেল, তা হলে মাথা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা তো করতেই হবে। কংগ্রেসের সঙ্গে হার্দিক পটেলের সমঝোতার সম্ভাবনা তৈরি হতেই তাই জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেল পতিদার নেতার নামে। রাজনৈতিক শিবির এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে রাজনৈতিক নকশা যে খুঁজে পাবেনই, সে নিশ্চয় বলাই বাহুল্য।
রাজনৈতিক আগ্রাসন, নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদ এবং প্রতিহিংসা পরায়ণতার অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। বিজেপি সে অভিযোগ অস্বীকার বা নস্যাৎ করতেই পারে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ এ ক্ষেত্রে বিজেপির পক্ষে বয়ান দেবে না।
শুধু গুজরাতে নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করার অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে গোটা দেশেই উঠছে। অরুণাচলে কী ভাবে কংগ্রেস সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, উত্তরাখণ্ডে কী ভাবে সরকার ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল, কেউই ভোলেননি। কী ভাবে দেশের নানা প্রান্তে ইডি, সিবিআই বা আয়কর হানা প্রায় রোজ চলছে এবং বিরোধী শিবির থেকে এই সব এজেন্সির পরিকল্পিত অপপ্রয়োগের অভিযোগ প্রায় রোজ উঠছে, সেও সকলেই দেখছেন। তাই হার্দিক পটেলের বিরুদ্ধে হঠাৎ জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার ঘটনাকেও এই সব ঘটনার থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখতে চান না অনেকেই। এই পরোয়ানাকেও একটা প্রবণতার অঙ্গ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। প্রবণতাটার বিরুদ্ধে গোটা বিরোধী শিবিরের কণ্ঠস্বরও ক্রমশ চড়া হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে যাবতীয় বিরোধিতা মুছে দেওয়ার সুযোগ বিরোধী শিবিরের অনেকেও যে ছাড়তে চাইছেন না, সে দৃষ্টান্তও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাইছে বিজেপি, অভিযোগ তৃণমূলের। ইডি, সিবিআই বা আয়কর হানার ভয় দেখিয়ে তৃণমূলকে ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। দেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলিকে বিন্দুমাত্র পরিসর ছেড়ে দিতে মোদী রাজি নন— তৃণমূলের অভিযোগের মূল উপজীব্য এই রকমই। কিন্তু তৃণমূল যেখানে শাসক, সেখানে বিরোধী দলের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছে তৃণমূলও। বাংলায় কোনও বিরোধী দলের দরকার নেই, অন্যায় দেখলে তৃণমূলই বিরোধিতা করবে— বার্তা আসছে বাংলার শাসকদের তরফ থেকে।
এই সব বার্তা আসলে একটা আগ্রাসী রাজনৈতিক মানসিকতা থেকে আসে। দীর্ঘ বাম জমানাতেও আমরা এই মানসিকতার পরিচয় পেয়েছি। আমরা দেখেছি, বিরোধীদের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন না বাম নেতারাও। বামফ্রন্টের বিকল্প অন্য কোনও দল নয়, বামফ্রন্টের বিকল্প উন্নততর বামফ্রন্ট— স্লোগান ছিল সে সময়ের শাসকদের। আজকের শাসকরাও একটু অন্য ভাবে একই কথা বলছেন— বাংলায় কোনও বিরোধী দলের প্রয়োজনই নেই, বিরোধিতার প্রয়োজন হলে তৃণমূলই বিরোধিতা করবে।
বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা যদি শাসকই মিটিয়ে দিতে পারতেন, তা হলে দেশের সংবিধানে বিরোধী দলের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ পরিসর সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই তো ছিল না। সংবিধান প্রণেতারা ভেবেচিন্তেই তো বিরোধী দলের মর্যাদা স্থির করেছিলেন। সেই মর্যাদাকে অস্বীকার করে সংবিধান কর্তৃক বিন্যস্ত গণতান্ত্রিক ভারসাম্যকেই চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে না কি? খুব গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখার সময় হয়েছে। এখনও যদি না ভাবি, তা হলে হার্দিক পটেলদের বিরুদ্ধে এমন আচমকা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার মধ্যে আর আশ্চর্য হওয়ার উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে না অদূর ভবিষ্যতে।