অতীব দুর্ভাগ্যজনক যে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের চোখে ভারত বিষয়ে আফ্রিকান কূটনীতিকদের এই মুহূর্তের ক্ষোভ ও হতাশা এতখানি ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ঠেকিতেছে। ‘একটি-দুইটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, যাহাতে নেহাতই দুর্বৃত্তরা জড়িত, কেন যে তাহা ভারতীয় সরকারের মাথাব্যথার কারণ হইবে, ইহার কোনও যুক্তি মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিরা দেখিতে পাইতেছেন না। দেশের এত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব যাঁহাদের হাতে, তাঁহারা নিজেদের দায় ও দায়িত্বই আদৌ বুঝিতে পারেন না! কোনও বিশেষ মহাদেশের নাগরিকদের প্রতি যদি একাদিক্রমে দুর্বৃত্ত হামলা চলিতে থাকে, সেও আবার রাজধানীর সন্নিকট অঞ্চলসমূহে, তাহা হইলে রাজ্য প্রশাসন বা কেন্দ্রীয় প্রশাসন, বিদেশ মন্ত্রক বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, কেন যে কেহই দায় এড়াইতে পারে না, সে কথা বুঝিতে পারেন না। এই সব বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব যে সার্বিক ভাবে ভারত সরকারের, তাই দেশের প্রশাসনের পক্ষ হইতে এই লাগাতার আক্রমণের বিরুদ্ধে যে কঠোর বার্তা প্রত্যাশিত ছিল, তাঁহারা বুঝিতে পারেন না। শুধু কৃষ্ণাঙ্গ নয়, যে কোনও সংখ্যালঘু কিংবা প্রান্তিক কিংবা বহিরাগত গোষ্ঠীর প্রতি স্পষ্ট লক্ষ্যে আক্রমণ চলিলে কঠিন হাতে তাহার মোকাবিলা করা যে কেবল সরকারের প্রশাসনিক কাজ নয়, বরং একটি অলঙ্ঘনীয় নৈতিক দায়িত্ব, তাহা ভাবিয়া উঠিতে পারেন না। কৃষ্ণাঙ্গদের উপর আক্রমণের ঘটনাই তো প্রথম নয়, ইহার আগেও এমন স্পষ্ট টার্গেট-এ বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ চলিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা নীরব থাকিয়াছেন। কোনও দেশের সরকার যদি গোড়া হইতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তাহার এই নৈতিক দায়িত্বটি উপেক্ষা করে, ধরিয়া লইতে হইবে যে এই ধরনের আক্রমণে তাহার নিহিত সমর্থন আছে, আক্রমণকারী যে বা যাহারাই হউক না কেন।
দেশেরই দুর্ভাগ্য যে বিদেশ মন্ত্রক অবলীলায় সব কর্তব্য কাঁধ হইতে ঝাড়িয়া ফেলিয়া বিক্ষুব্ধ আফ্রিকান পক্ষকে পাল্টা আক্রমণ করিয়া বসিল। এই দুর্বৃত্তরা কাহারা, কোন দলের, সরকারি পক্ষের না বিরোধী পক্ষের, সেই সূক্ষ্ম বিচার এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। যত দূর জানা যায়, কোনও দলের পক্ষ হইতে এই অন্যায় নির্যাতন সংঘটিত হয় নাই, বৃহৎ সমাজ হইতেই উঠিয়া আসিয়াছে। কৃষ্ণাঙ্গবিরোধিতায় সব মত সব বর্ণের ভারতীয়ই সমান সক্রিয়, সমান কুসংস্কারাচ্ছন্ন, এ কথা তো নূতন নহে। কিন্তু তাহাতে কী! নরেন্দ্র মোদী, সুষমা স্বরাজ কিংবা রাজনাথ সিংহদের তো এই বৃহৎ সমাজেরই কর্ণধার, এবং প্রয়োজনে অভিভাবক হইবার কথা ছিল! তাঁহারা তো কেবল বিজেপির সরকার চালাইতে দিল্লির মসনদে বসেন নাই, গোটা দেশের সরকার হইয়াছেন। কয়েকটি সময়োচিত কঠোর ভর্ৎসনা-বাক্যে তাঁহাদের কোনও ক্ষতি হইত না, বরং গরিমা বাড়িত। সময়োচিত কর্তব্য না করিয়া মাঝখান হইতে নিশ্চুপতা ও আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দিয়া তাঁহারা নিজেদের স্কন্ধে দায়টি আনিয়া ফেলিলেন।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে ভারত কেমন রূপে প্রতিভাত হইতেছে, তাহা লইয়া অবশ্য মোদী সরকারের বিশেষ দুর্ভাবনা নাই। কেননা কূটনীতি বলিতে তাঁহারা যে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের জয়গান বোঝেন, তাহাতে নিজের দেশকে বলীয়ান দেখাইবার আগ্রহে অন্য দেশের অধিকার ও আবেগ ক্ষুণ্ণ করিলে বিন্দুমাত্র ক্ষতি নাই। আফ্রিকার সহিত কূটনীতির নবযুগ উদয়ের আশায় প্রধানমন্ত্রী মোদী বড় বড় পরিকল্পনা করিতে পারেন। কিন্তু দেশের মাটিতে আফ্রিকার নাগরিকরা নিগৃহীত হইলে তিনি এবং তাঁহারা হাত ধুইয়া ফেলেন। ইহাই বর্তমান উদ্ধত সংকীর্ণমনা ভারতের কূটনৈতিক কৃৎকৌশল। নূতন ভারতের সহিত বহির্বিশ্বের সম্পর্ক কেমন হইবে, নূতন কৃৎকৌশলই তাহা নির্ধারণ করিয়া দিবে।