স্ত্রী বা কন্যা কারও কাছেই লোকটি আর আশ্রয় পেল না

নাটকে মেয়েটি বলল, বিয়ে করার শর্ত হল, তাকে কুড়ি হাজার টাকা পণ দিতে হবে। এই শুনে আমিন অবাক। লিখছেন হরিমাধব মুখোপাধ্যায়নাটকে মেয়েটি বলল, বিয়ে করার শর্ত হল, তাকে কুড়ি হাজার টাকা পণ দিতে হবে। এই শুনে আমিন অবাক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৯ ০৮:১৮
Share:

বাণপ্রস্থ: ত্রিতীর্থের-প্রযোজনা। ফাইল চিত্র

অমর মিত্রের ‘তাল খেজুরে’ গল্পটা পড়ে আমার বেশ মনে ধরে। কেননা গল্পটা পণপ্রথা নিয়ে লেখা। তার মধ্যে বেশ একটা নাটকীয় ব্যাপার ছিল। তাই এই গল্প অবলম্বনে আমি মুর্শিদাবাদ ও মালদার ডায়লেক্টে ‘অসমাপিকা’ নাটকটি লিখি।

Advertisement

নাটকে দেখা যায় যে, মেয়েটিকে তার বাবা কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে এক জনের সঙ্গে বিয়ে দেয়, সেখানে মেয়ের ইচ্ছে অনিচ্ছার গুরুত্ব বাবার কাছে ছিল না। বিয়ের পর মেয়েটি স্বামীর ঘরে নানা ভাবে অত্যাচারিত হয়, কিন্তু মুখ বুজে সব সহ্য করছিল। শেষ অবধি আর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে ছেড়ে বাবার কাছে ফিরে আসে। ফিরে আসার পর সে এটা বুঝতে পারে যে, বাবা তাকে বিয়ের নাম করে বেচে দিয়েছিল। তখন থেকে সে মনে মনে স্থির করে বাবার এই ঋণ সে একদিন শোধ করে মুক্ত হবে। এমন সময় একজন আমিন গোছের লোক, তার থেকে বয়সে বেশ বড়, সে এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়। এ কথা সে মেয়েটিকে সরাসরি জানায়। মেয়েটি তখন ওই লোকটিকে বলে, ‘‘আপনি জানেন তো যে আমার একবার বিয়ে হয়েছে। তারপরও যদি আমাকে বিয়ে করতে চান তাহলে আমার একটা শর্ত আছে।’’ লোকটি তা জানতে চায়। মেয়েটি তখন তার কাছে কুড়ি হাজার টাকা পণ চায়। কেননা সে এই টাকা নিয়ে বাবার ঋণ শোধ করে দায় মুক্ত হতে চায়। মেয়েটির এই কথা শুনে আমিন লোকটি বেশ অবাকই হয়।

পরে মেয়েটির বাবার কাছে আমিন লোকটি গোটা ব্যাপারটা খুলে বলে। লোকটির কাছে একথা জানতে পেরে মেয়েটির বাবা মনে মনে একটা ফন্দি আঁটে। মেয়েকে না জানিয়ে আমিনের সঙ্গে তার বাবা দেখা করে জানায়, ‘‘আমি তোমাকে কুড়ি হাজার টাকা দিতে রাজি আছি, তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে কর।’’ একথা শুনে আমিন বুঝতে পারে টাকাটা আবার মেয়ের বাবার কাছেই ফিরে যাবে। তখন তার ভিতরে একটা সংশয় হয় এবং শেষ পর্যন্ত সে আর বিয়ে করতে রাজি হয় না। অন্যদিকে মেয়েটা আর কোনও উপায় না পেয়ে আত্মহত্যা করে। আমি নাটকটি শেষ করি এরকম ভাবে—একটি ফাঁকা রেল স্টেশনের একই বেঞ্চের দু-ধারে মেয়েটির আগের স্বামী ও এই আমিন লোকটি পাশাপাশি বসে থাকে, ধীরে ধীরে আলো কমতে থাকে ও পর্দা পড়ে। নাটকটির প্রযোজনা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

Advertisement

এরপর আমি ‘বাণপ্রস্থ’ বলে একটা নাটক লিখি। যদিও তা প্রথমে ‘অজ্ঞাতবাস’ নামে প্রকাশিত হয়। পরে আমার নির্দেশনায় ও ত্রিতীর্থের প্রযোজনায় তা ‘বাণপ্রস্থ’ নামেই মঞ্চস্থ হয়। নাটকের ঘটনাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। এক জন গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি অন্য একটি শত্রু দেশে প্রায় তিরিশ বছর জেলে থেকে নিজের দেশে ফিরে আসে। তখন তার নিজের দফতরের লোকজন তাকে তার বাড়ি ও স্ত্রীর সন্ধান দেয়। সে দেখা করতে আসে। তাকে দেখে তার স্ত্রী অবাক এবং দ্বিধান্বিত। লোকটি যখন তিরিশ বছর আগে শত্রু দেশে আটকে যায় তখন তার একটি ছোট্ট মেয়ে ছিল, আজ মেয়েটিও অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আর তার স্ত্রী অন্য আর একজনকে বিয়ে করে নতুন সংসার করছে। অন্য দিকে তার স্ত্রীও লোকটিকে আর গ্রহণ করতে পারছে না। এইরকম পরিস্থিতিতে লোকটি কাউকে কোনও ঠিকানা না দিয়ে অজ্ঞাতবাসে চলে যায়। এই নাটকটিও দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিল।

ডবলিউ ডবসিউ জেকবের ‘মাংকিজ পো’ অবলম্বনে ‘করকূহক’ নাটকটা আমি যে লিখলাম আমার মতো করে সেটাতেও একটা কেজো কারণ রয়েছে। আমার পুত্র (কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়) তখন যাদবপুরের ছাত্র, ওদের ‘মাংকিজ পো’ নাটকটি পাঠ্য ছিল। ও আমাকে একদিন ফোন করে বলে, ‘‘বাবা, ওই নাটকটা থেকে আমাদের একটা প্রশ্ন আসতে পারে—নাটকটা মেটাফিজিক্যাল নাকি মেটাফিজিক্যাল বিরোধী? এই ধরনের একটা প্রশ্ন, তা আমি ভাল করে ট্যাকল করতে পারছি না। তুমি যদি একটু দেখো আর লিখে পাঠাও।’’ ‘মাংকিজ পো’ নাটকটা যদিও আমার আগে পড়া ছিল তবুও আবার নতুন করে পড়লাম। নাটকটা পড়ে আমি আমার মতো করে একটা উত্তর লিখে পাঠালাম। তাতে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম যে, নাটকটা মেটাফিজিক্যাল নয়, বরং তার বিরুদ্ধে লেখা। যাই হোক, সেই সূত্র ধরেই আমার মনে হয়েছিল যে নাটকটা তো ভীরতীয়করণ করা যায়। তারপর আমি চেষ্টা করি এবং অবশেষে ‘করকূহক’ নাম দিয়ে নাটকটা লিখে ফেলি।

এই নাটকে আমি প্রাক্তন মেজরের রোলটা করতাম, এই চরিত্রটা জেকবের নাটকে ছিল না। কীভাবে সে ওই হাতটা পেল সেটা প্রমাণ করতেই আমাকে এই চরিত্রটা যোগ করতে হয়। এই নাটকটাতে অভিনয়ের অনেক সূক্ষ্ম কাজ ছিল, যাঁরা ধরতে পারেননি তাঁরা ভেবেছেন, মাধবদা একটা মেটাফিজিক্যাল নাটক করেছেন। আসলে আমি তা করিনি, বরং মেটাফিজিক্যাল বিরোধী নাটক ওটা—সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। যারা নাটকটাকে মেটাফিজিক্যাল বলেছিল তারা বেশিরভাগই কমিউনিস্ট। তাদের আমি বোঝাতে পারিনি যে নাটকটা আসলে একটা ইউনিভার্সাল ট্রুথকে তুলে ধরেছে, ডিজায়ার নেভার এন্ডস— এটাই তো ইউনিভার্সাল ট্রুথ। ডিজায়ারই আমাদের কতকগুলো ক্যাটাসট্রফিতে ফেলে। অপ্রয়োজনীয় ডিজায়ার—যা কখনও পূরণ হওয়ার নয়, সেই ডিজায়ার যদি আমি করি, তার ফল তো আমাকেই পেতে হবে। এই জন্য বোধহয় নাটকটা পৃথিবী বিখ্যাত ছিল। আর আমাদের এই নাটকের প্রযোজনাও বেশ সুনাম অর্জন করেছিল।

(মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন