কোনও কিছুর জন্যই উত্তরবঙ্গ ছাড়েননি অশ্রুদা

নিজের জায়গায় থেকে নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে সকলের কাছে প্রতিভাত হয়েছেন। এই মানসিকতা সত্যিই বিরল। লিখছেন হরিমাধব মুখোপাধ্যায় নিজের জায়গায় থেকে নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে সকলের কাছে প্রতিভাত হয়েছেন। এই মানসিকতা সত্যিই বিরল। লিখছেন হরিমাধব মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:১৬
Share:

অশ্রুকুমার-সিকদার। ফাইল চিত্র

সকালে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, জানতাম তিনি আছেন। এখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, তবু আছেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানেই গিয়েছিলাম। তাই সকাল থেকেই বারবার তাঁর কথা মনে পড়়ছিল। দুপুরে ফিরলাম। পকেটে ফোনটা বন্ধ ছিল। দেখলাম এক রাশ মিসড কল। কী হয়েছে? এত জন ফোন করেছেন কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করার পরে বাগ্‌রুদ্ধ হয়ে গেলাম। তিনি নেই।

Advertisement

অশ্রুকুমার সিকদারের (আমি অশ্রুদা বলেই ডাকতাম) সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা যে দীর্ঘ দিনের। তিনি শিলিগুড়ির দেশবন্ধু পাড়াতে থাকতেন, বাইরে দেখলে খুবই সাধারণ একটি বাড়ি বলেই মনে হবে। কিন্তু ভিতরে যখন ঢুকতাম আমার মনটা আনন্দে ভরে যেত চারদিকে শুধু বই আর বই দেখে। নিজেরই মনে হত যেন ভুল করে পাড়ার কোনও লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছি। আর এই ভেবে অবাক লাগত যে কী করে একটা মানুষ এই উত্তরবঙ্গে বসে এতো বইয়ের সন্ধান ও সংগ্রহ করেছেন ওই সময়ে দাঁড়িয়ে! দিন রাত বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন মানুষটি। আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেখলেই অশ্রুদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে এক গাল হেসে বলে উঠতেন, ‘‘দুধ দিয়ে কফি করো, সেই সঙ্গে একটা অমলেট। বালুরঘাট থেকে হরিমাধব এসেছেন।’’

সেই সঙ্গে বৌদির সহাস্য আপ্যায়ন দেখে আমার মনে হত যে, আমি যেন এই বাড়িরই একজন হয়ে গেছি। কতবার যে তাঁদের শিলিগুড়ির বাড়িতে গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আজ এই কথাগুলো মন পড়ছে খুব।

Advertisement

অশ্রুদা অনেক সময় ধবধবে সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতেন, সেই সঙ্গে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। বাইরে থেকে দেখলে বেশ গম্ভীর মনে হত কিন্তু কিছু ক্ষণ কথা বলার পর মনে হত, তাঁর মতো আপন আর কেউ হয় না। অথচ এই মানুষটি আজ আর নেই। এই মানুষটির জন্য আমার গর্ববোধ হয় যে, তিনি কোনও দিন নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করেননি। আগাগোড়াই উত্তরবঙ্গে থেকেছেন—প্রশংসা, খ্যাতি কিংবা প্রতিপত্তির জন্য কখনওই কলকাতামুখী হননি। নিজের জায়গায় থেকে নিজের কাজের মধ্য দিয়ে নিজেই প্রতিভাত হয়েছেন। এই মানসিকতা সত্যিই বিরল।

মনে পড়ে যায় সুকুমার সেনের কথা। কোনওদিন ভারতের বাইরে যাননি। প্রধানত সারা জীবনটাই কাটিয়েছেন কলকাতায়। কিন্তু সারা জীবন ধরে কাজ করে গিয়েছেন। অশ্রুদা বাসভূমির আরও ঘনিষ্ঠ। তিনিও সারা জীবন কাজ করেছেন।

আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ ছিলাম। পাণ্ডিত্য নিয়ে তাঁর মধ্যে কখনও কোনও অহঙ্কার ছিল না, তাই মানুষটিকে সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা করতাম। আমার নাটক করার মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা। আর ঘনিষ্ঠতা এমনই ছিল যে, তাঁকে আমি আমার মনের কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারতাম। আমাকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করতেন। এ নিয়ে আমি অনেক পীড়াপীড়ি ও আপত্তি করলে তিনি একগাল হেসে জবাব দিতেন, ‘‘আপনি শিল্পী মানুষ, ফলে তুমি বলি কেমন করে?’’ যদিও কখনও সখনও ‘তুমি’ বলে ফেলতেন, কিন্তু পরক্ষণেই শুধরে ‘আপনি’ বলতেন। আমার তা নিয়ে খুবই অস্বস্তি হত, অথচ আমি নিরুপায় ছিলাম।

আমার অনেক নাটক তিনি দেখেছেন, তা নিয়ে পরে আলাদা করে আমার কাছে জানতে চাইতেন, নাটকের অমুক দৃশ্যটি কেন আনলাম, কেন নাটকটাকে ওই ভাবে শেষ করলাম? আমার উত্তর ও যুক্তিগুলো তিনি মন দিয়ে শুনতেন এবং যে জায়গাগুলো ভাল লাগতো, অকুণ্ঠভাবে প্রশংসা করতেন। যদিও তিনি কোনও দিনই বালুরঘাটে এসে ত্রিতীর্থের মঞ্চে নাটক দেখেননি, সব নাটকই আমরা যখন শিলিগুড়িতে আমন্ত্রিত অভিনয় করতে যেতাম, তখন সেখানেই তিনি দেখতেন। একবারই তাঁকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। কোনও এক সেমিনারে তিনি বালুরঘাটে গিয়েছিলেন, সম্ভবত শীতকাল হবে। সেমিনারের শেষে আমি তাঁকে বাসে তুলে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। দেখি তিনি ঠান্ডায় বেশ কষ্ট পাচ্ছেন, তখন আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁকে একটি শাল দিই।

আমিও আমার কিছু জিজ্ঞাসা খুব সহজে করতে পারতাম। যেমন—শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটককে শঙ্খ ঘোষ ‘বাংলার শ্রেষ্ঠতম নাটক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলাম, কোন দিক থেকে নাটকটি শ্রেষ্ঠতম? সেই সঙ্গে এই নাটক নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু মতামত জানিয়েছিলাম। সব কথা শুনে টুনে তিনি আমার কিছু কিছু যুক্তির সঙ্গে সহমত হয়েছিলেন, সেই সঙ্গে সহজ ভাবে পুরো বিষয়টি আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, যা আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। কিংবা শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’ প্রযোজনায় কেন তৃপ্তি মিত্রের গলায় নন্দিনীর গান গাওয়ানো হল না? কেন তা নিয়ে কেউ কোনও আপত্তি করলেন না? এই রকম নানা প্রশ্ন আমি অনায়াসে করতে পারতাম। যা শুনে তিনি কোনও দিন বিরক্ত হতেন না।

তিনি নিজের হাতে আমাকে তাঁর লেখা ‘বাক্যের সৃষ্টি’, ‘কিল মারার গোঁসাই’ এবং আরও কয়েকটি বই উপহার দিয়েছিলেন। আমি একবার তাঁর লেখা একটি বই নিজে কিনে এনেছি শুনে বলেছিলেন, ‘‘এটা আপনি কী করলেন! এই বইটা তো আমার কাছ থেকেই আপনার প্রাপ্য ছিল।’’ বইগুলো পড়ার পর আমি মতামত জানাতাম, তা তিনি খুব যত্ন সহকারে শুনতেন। একবার রবীন্দ্রনাথের উপর লেখা ‘বাক্যের সৃষ্টি’ বইটি নিয়ে আমার আলোচনা শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আপনি একজন নাটক করিয়ে হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাটককে কেমন করে বুঝছেন তা লিখুন। কোনও সমালোচনা পড়ার দরকার নেই, আপনার নিজের যা মনে হচ্ছে তাই লিখুন।’’ তাঁর এই উৎসাহে আমি একটা খাতায় লেখা শুরু করেছিলাম এবং অনেকটা লিখেও ফেলেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, একদিন ট্রেনে ওই খাতাসহ আমার কাঁধের ঝোলাটি হারিয়ে যায়। পরে আর নতুন করে লিখতে পারিনি।

এতো বড় মাপের একজন মানুষ, যিনি নিজের জায়গায় থেকে একের পর এক কাজ করে গিয়েছেন, সেই মানুষটি অনেক প্রাপ্য সম্মান থেকে অবহেলিত হয়েছেন।

কেন এই অবজ্ঞা? তিনি কলকাতামুখী হননি বলে? অথচ এই মানুষটির কাজ করার উদ্যমতা আমাকে বিস্মিত করত। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘‘চোখ দু’টো আমার অন্তরায় হয়ে উঠেছে, অনেক কাজ করার ছিল কিন্তু করে উঠতে পারছি না।’’ অনেকটা আড়ালেই থেকে গেলেন, অথচ তিনি অনেক বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। উত্তরের নিজস্ব উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের পতন হল।

(মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন