মানভূমের ইতিহাস এবং ভজহরি মাহাতো

পুরুলিয়া জেলার সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক অবয়ব গঠনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়! বর্তমান রাজনীতিকদের কাছে তাঁর জীবনচর্যা পাঠ্যবিষয়ের শামিল। যাঁর সমস্ত জীবন এই জেলার মানুষের জন্য নিবেদিত, তিনি কি পেয়েছেন তাঁর যোগ্য সম্মান? লিখছেন প্রদীপকুমার মণ্ডল পুরুলিয়া জেলার সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক অবয়ব গঠনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়! বর্তমান রাজনীতিকদের কাছে তাঁর জীবনচর্যা পাঠ্যবিষয়ের শামিল। যাঁর সমস্ত জীবন এই জেলার মানুষের জন্য নিবেদিত, তিনি কি পেয়েছেন তাঁর যোগ্য সম্মান?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:০৫
Share:

ভজহরি মাহাতো। ফাইল চিত্র

পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি। সঙ্গে ধুতি। আর কাঁধে খদ্দরের ব্যাগ। এই নিয়ে মাইলের পর মাইল তিনি পায়ে হেঁটে চলেছেন। কখনও তাঁর সাইকেলটিও তাঁর সঙ্গী। ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাবেক মানভূমের বিভিন্ন এলাকায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যা পুরুলিয়া নামে খ্যাত। পথ চলতে গিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি। তাঁদের অভাব অভিযোগের কথা শুনছেন। সাধ্যমতো তার প্রতিকারের চেষ্টাও করছেন। লোকটি ভজহরি মাহাতো। পুরুলিয়া জেলার সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক অবয়ব গঠনে যাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

Advertisement

ভজহরিবাবুর জন্ম ১৯১১ সালে সাবেক মানভূম জেলার বান্দোয়ান থানার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জিতান গ্রামে। বাবার নাম চুনারাম মাহাতো। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারেননি। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছে ছিল। তাই বোধহয় মাত্র ১৯ বছর বয়সে মানভূমের গাঁধীবাদী নেতা অতুলচন্দ্র ঘোষের অনুপ্রেরণায় তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন।

১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের অন্যতম সেনানী ভজহরি ১৯৪২ সালে অগস্ট আন্দোলনেরও অন্যতম সহকারী ছিলেন। জানা যায়, অগস্ট আন্দোলন চলাকালীন মানভূম জেলা কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা যখন গরাদের পিছনে, তখন ভজহরিবাবুর বাড়িতেই কংগ্রেসের জেলা কর্মসূচির গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠকে জেলার বিভিন্ন থানাগুলি দখল করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভজহরি মাহাতোর নেতৃত্বেই জিতান গ্রামের যুবকেরা সারারাত গ্রাম পাহারা দিয়ে এই গোপন বৈঠক সফল করেছিলেন। ভজহরিবাবুর নেতৃত্বেই সত্যাগ্রহীরা বান্দোয়ানের তহশিলদারের অফিস ধ্বংস করেন। বান্দোয়ান থানা দখল করার পরে ওড়ে তেরঙা জাতীয় পতাকা। ব্রিটিশ সরকারের আমলে তাঁর সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। পাঠানো হয় ভাগলপুরের জেলে। সেখান থেকে অবশ্য ১৯৪৬ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় সাধারণ মানুষকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে তৈরি করেছিলেন জন পঞ্চায়েত।

Advertisement

১৯৪৮ সালের ১৩ জুন মানভুম জেলা কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা কংগ্রেস ত্যাগ করে ‘লোকসেবক সংঘ’ নামে একটি পৃথক সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই দলের সভাপতি হন অতুলচন্দ্র ঘোষ এবং সম্পাদক বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত। ভজহরি মাহাতোও সে সময় কংগ্রেস ছেড়ে রাজনীতির গুরু অতুলচন্দ্রের দলে যোগ দেন। অন্য দিকে, স্বাধীনতা লাভের পরে শুরু হয়েছে অন্য সংগ্রাম। মানভূমের বাংলাভাষি মানুষের উপর হিন্দি ভাষা ‘চাপিয়ে’ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিহার সরকারের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বাংলাভাষী মানুষেরা। মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ভাষা আন্দোলনও শুরু হয়েছে। লোকসেবক সংঘে যোগ দেওয়ার পরে ভজহরি মাহাতো এই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। বিহার সরকার একাধিক বার তাঁকে গ্রেফতার করে। তা সত্ত্বেও তিনি এই আন্দোলন থেকে সরে আসেননি।

১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে দেশের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা সংক্রান্ত বিরোধ দূর করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছ থেকে জনমত সংগ্রহ করা শুরু করে। মানভূমের মানুষের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য লোকসেবক সংঘ টুসুগানের মাধ্যমে বিহার সরকারের অত্যাচারের কাহিনি প্রচারিত হতে থাকে। তখন বিহার সরকার টুসু গান গাওয়া বেআইনি ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে লোকসেবক সংঘ ১৯৫৪ সালে শুরু করে টুসু সত্যাগ্রহ। ভজহরিবাবু সেই সময় টুসু সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর লেখা টুসু গান খুব জনপ্রিয় হয়। বিশেষত, ‘শুন বিহারি ভাই তোরা রাখতে লারবি ডাং দেখাই (দিখাই)’। সে সময়েও ভজহরিবাবুকে কিছুদিনের জন্য গ্রেফতার করেছিল বিহার সরকার।

সমস্যা মেটাতে ১৯৫৪ সালে বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারকে নিয়ে ‘যুগ্মপ্রদেশ’ গ্রঠনের প্রস্তাব দেন কেন্দ্রের কাছে। সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে লোকসেবক সংঘ। পুরুলিয়া থেকে কলকাতা পর্যন্ত দীর্ঘ পদযাত্রা কর্মসূচি পালিত হয়। এই পদযাত্রা বঙ্গ সত্যাগ্রহ নামে খ্যাত। মৃদঙ্গ বাজিয়ে এবং গান গেয়ে সেই পদযাত্রায় অন্য মাত্রা যোগ করেছিলেন ভজহরিবাবু। পরে অবশ্য এই যুগ্নরাজ্য গঠনের প্রস্তাব বাতিল হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৬টি থানা এলাকা নিয়ে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হয় নতুন পুরুলিয়া জেলা। তবে ভজহরিবাবুদের দাবি সত্ত্বেও ধানবাদ-সহ শিল্প সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলিকে সে সময় পুরুলিয়া জেলা থেকে বাদ দিয়ে তৎকালীন বিহারেই রাখা হয়েছিল।

সফল রাজনৈতিক নেতা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সফল সাংসদের ভূমিকাও পালন করেছিলেন ভজহরি মাহাতো। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভজহরি মাহাতো এই নির্বাচনে পুরুলিয়া কেন্দ্র থেকে লোকসেবক সংঘের রেল ইঞ্জিন প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেছিলেন। বিহার সরকারের মানভূমের ভাষা আন্দোলনকারীর উপরে অত্যাচারের কথা তুলে ধরেছিলেন লোকসভায়। পরবর্তী সময়ে ভজহরি মাহাতো দু’বার সাংসদ নির্বাচিত হন। জেলায় শিক্ষার বিস্তারেও তাঁর অবদান কম নয়। বান্দোয়ান ঋষি নিবারণ চন্দ্র বিদ্যাপীঠ, বান্দোয়ান বালিকা বিদ্যালয় প্রভৃতি স্কুল তৈরিতে তিনি বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হন। ২০০৩ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

ব্যক্তিগত ভাবে ভজহরি মাহাতো খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। দীর্ঘ ১৫ বছর সাংসদ থাকলেও তাঁর বাড়ি ছিল মাটির তৈরি। ছাউনি খড়ের। ঘরের আসবাব পত্রও খুবই সাধারণ। ছিল পিতৃসূত্রে পাওয়া কয়েক বিঘা জমি, যেখানে তিনি নিজেই চাষ-আবাদ করতেন। ১৯৮১ সালে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের সদস্যেরাও তাঁর এই সাধারণ জীবনযাপন দেখে অবাক হয়েছিলেন।

দুর্ভাগ্যের বিষয় পুরুলিয়া জেলার মানুষ ভজহরি মাহাতোকে তাঁর প্রাপ্ত মর্যাদা দেয়নি। শুধু বান্দোয়ান শহরে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে এবং সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ইতিহাস পাঠক্রমে যুক্ত হয়েছে মানভূমের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলন এবং ভজহরি মাহাতোর অবদান। বর্তমান রাজনীতিকদের মাঝে ভজহরি মাহাতোর মতো রাজনীতিকের জীবনচর্যা সকলের সামনে উঠে আসা বর্তমান সময়ে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। সে কথা ভুললে চলবে না।

পুরুলিয়া মানভূম মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন