রাজধর্ম আর রাজনীতি

উগ্র হিন্দুত্ববাদের সব চেয়ে বড় সুবিধাটি পেয়েছিলেন বাজপেয়ী

বাজপেয়ী মানুষ হিসেবে উদার ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন, কিন্তু আডবাণীর বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-বজরং দল এবং আরএসএস, এই ত্রয়ী শক্তির মাধ্যমে গোটা দেশ জুড়ে বিজেপির যে শক্তি বৃদ্ধি, তার সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক লাভ কিন্তু পেয়েছেন বাজপেয়ী নিজেই।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

একটা মানুষ যখন আমাদের মধ্যেই থাকেন, তখন অনেক সময় আমরা তাঁর সমালোচনা করি। তাঁর আড়ালে অনেক গুঞ্জন। বিখ্যাত জননেতা হলে প্রতিপক্ষ নিন্দুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আর, সেই মানুষটিরই প্রয়াণের পর আমরা তাঁর আরাধনা শুরু করে দিই।

Advertisement

মৃত্যুর পর সাধারণত আমরা তাঁর সম্পর্কে আর কটু কথা বলি না। শুধু বাঙালি বলে নয়, এ বোধ হয় সর্বভারতীয় প্রবণতা। মহাভারতে স্বর্গারোহণ পর্বে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে প্রথম দেখতে চেয়েছিলেন কর্ণকে। কুরুক্ষেত্রে যা হয়েছে, হয়েছে— এখন স্বর্গে এসে যুধিষ্ঠিরের সম্ভবত অপরাধ বোধ হচ্ছিল। যখন শুনলেন, কর্ণ নরকে আছেন, এমনকি দ্রৌপদী আর তাঁর ভাইরাও, তখন তিনি নরকেই যেতে চাইলেন তাঁদের দেখতে।

হতে পারে মৃত্যুর পর সমালোচনা ভারতীয় চলতি সংস্কৃতি নয়। কিন্তু তা বলে অতীতাসক্তির জন্য ব্যক্তির প্রতি মোহান্ধতা ইতিহাসকে বিকৃত করে, সে কথাই বা অস্বীকার করি কী করে। সত্য সে কঠিন, কিন্তু সে কখনও করে না বঞ্চনা! অটলবিহারী বাজপেয়ীর মৃত্যুর পর দেখছি বিরোধী শিবির এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশ প্রচার জুড়ে দিয়েছেন, বাজপেয়ী ছিলেন নেহরু-ভক্ত। নেহরুর দর্শনকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি ঐকমত্য চাইতেন। ছ’বছরের শাসনে তিনি রাজধর্ম পালন করেছেন। যোগ্য নেতৃত্ব। সকলকে নিয়ে চলতেন। সহিষ্ণু ছিলেন। আর এই ভূয়সী প্রশংসার মর্মকথা একটাই— বাজপেয়ী ছিলেন দারুণ প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না।

Advertisement

হে পাঠক, এখানে আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, এই প্রচার চালিয়ে আমরা নরেন্দ্র মোদীর প্রতিও অবিচার করছি। আপনি নরেন্দ্র মোদীর পাঁচ বছরের শাসন কালের কড়া সমালোচনা করতেই পারেন। ব্যক্তি বাজপেয়ীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমিও বলেছি, কেমন মজার মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর উদারতা, তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনন— এ সব কোনওটাই অসত্য নয়। কিন্তু তাঁর রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, সেখানে আছে নানা স্তর। অনেক আপস। অনেক ক্ষমতার রাজনীতি। কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ, সে বিতর্ক সারা জীবন তাঁর সঙ্গে পথ চলেছে।

গুজরাত-কাণ্ডের পরে পরেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদী সন্ধের আগেই নিজের সরকারি ছোট বিমানে ফিরে যান আমদাবাদ। পর দিন সমস্ত খবরের কাগজে বিরাট খবর— গুজরাত নিয়ে ক্ষুব্ধ বাজপেয়ী ধমক দিলেন মোদীকে। চাকরি যেতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর। তখন টিভি চ্যানেলের দাপট এতটা ছিল না। দিল্লির খবর শুনে মোদীর তো মাথায় হাত। দিল্লিতে ফোন করে এক সাংবাদিককে বললেন— ‘‘আশ্চর্যের ব্যাপার হল, কাল বৈঠকে অটলজি তো এ সব কথা কিছুই বলেননি। বরং ভাল মেজাজে ছিলেন। যা হয়েছে, হয়েছে— এখন পরিস্থিতি সামলে নাও, এটাই ছিল তাঁর উপদেশ।’’ মোদীও সে দিন আজকের মোদী ছিলেন না। তিনি বুঝতেই পারছিলেন না, কী ভাবে সবাই মিলে একই খবর লিখল? কারণ ছিল, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহল থেকে সে দিন বাছাই সাংবাদিকদের এ খবর দেওয়া হয়েছিল। তখনও বাজপেয়ীর ‘স্পিন ডক্টর’রা ছিলেন। ছিল ‘সিলেকটিভ লিকেজ’-এর কৌশল।

পরে বাজপেয়ী প্রকাশ্যে রাজধর্ম পালনের কথা বলেছিলেন মোদীর সামনে, আর মোদী তাঁর সামনেই বলেছিলেন, ‘‘সেই রাজধর্মই তো পালন করছি।’’ কিন্তু আমি পাঠককে মনে করাতে চাই, গুজরাত-কাণ্ডের পর নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মোদীর লেখা একটি বই প্রকাশ করেন বাজপেয়ী। মোদীকে পাশে বসিয়ে। সে দিন আরএসএস-এর বহু শীর্ষ নেতাও হাজির ছিলেন। আমি সে অনুষ্ঠানে ছিলাম। মোদীর ভূয়সী প্রশংসাও করলেন তিনি। দু’জনের সম্পর্কের রসায়নে কোনও সমস্যা সে দিন চোখে পড়েনি।

গুজরাত-কাণ্ডের পর গোয়ায় জাতীয় কর্মসমিতির যে বৈঠকে মোদীর চাকরি যাওয়ার কথা ছিল, সে সময়টা খুব মনে পড়ে। সকালে চন্দ্রবাবু নাইডুর বিবৃতি— মোদীকে ইস্তফা দিতে হবে। হোটেলের ঘর থেকে ফোন করলাম লালকৃষ্ণ আডবাণীকে। তিনি বললেন, কোনও পরিবর্তন হবে না। বাজপেয়ীর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রবাবু তো বিজেপির কেউ নন। চন্দ্রবাবু এই কথা বলায় দল এখন আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। আডবাণী আরও বললেন, বিকেল তিনটের সময় জনা কৃষ্ণমূর্তি সাংবাদিক বৈঠক করে তোমাদের দলের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবেন। পরে জেনেছিলাম, আডবাণী আরএসএস-এর সঙ্গেও এ ব্যাপারে কথা বলে নিয়েছিলেন। মোদী থাকলেই যে আসলে দলের লাভ, সেটা বাজপেয়ীও বুঝেছিলেন। মোদী মুখ্যমন্ত্রী থেকে যাওয়ার পর বাজপেয়ী আর কোনও বিবৃতি দেননি।

বিজেপি রামমন্দির আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৮৯ সালে হিমাচলপ্রদেশের পালমপুরে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে। এই বৈঠকে বাজপেয়ী এই আন্দোলনের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন, এ কথা সত্য। কিন্তু আডবাণীর পক্ষে ছিল পুরো দল। সঙ্ঘ পরিবারও ছিল আডবাণীর পিছনে। ফলে বৈঠকে আন্দোলনে সিলমোহর লাগল। শুরু হল রথযাত্রা। সে সময় আডবাণীকেই বলা হত ‘প্রাইম মিনিস্টার ইন ওয়েটিং’। আর বাজপেয়ী তাঁর সম্ভাব্য বিদেশমন্ত্রী। এর পর এল জৈন ডায়েরি। রাও জমানার হাওয়ালা চার্জশিট।

দেখা গেল, রামমন্দির আন্দোলন ভারতীয় রাজনীতিতে নিয়ে এল নতুন মেরুকরণ। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যখন মণ্ডল বনাম কমণ্ডলুর রাজনীতি তীব্র হয়ে উঠল, তখন ক্রমশ আডবাণীর ভাবমূর্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল উগ্র হিন্দুত্ব, আর বাজপেয়ী হলেন উদারপন্থী।

একের পর এক ঘটনা। আমি শুধু একটাই কথা বলতে চাইছি— এ সমস্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ হচ্ছে, বাজপেয়ী মানুষ হিসেবে উদার ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন, কিন্তু আডবাণীর বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-বজরং দল এবং আরএসএস, এই ত্রয়ী শক্তির মাধ্যমে গোটা দেশ জুড়ে বিজেপির যে শক্তি বৃদ্ধি, তার সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক লাভ কিন্তু পেয়েছেন বাজপেয়ী নিজেই। তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন বিজেপির রামমন্দির কৌশলের সফলতার জন্যই।

সময় রাজনীতির মুখ আর মুখোশ বদলাতেই থাকে। পাকিস্তান সফরে গিয়ে জিন্নাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলার পর আডবাণী হয়ে গেলেন উদার আর মোদী কট্টর হিন্দুত্ববাদী! আমেরিকা তাঁকে ভিসা দেয় না। তার পর আজ তিনি প্রধানমন্ত্রী। ক্রমশ বিজেপির রাজনীতিতে যিনি হয়তো উদার হয়ে উঠবেন, আর সে দিন হয়তো সঙ্ঘ পরিবারের কট্টর মুখোশটা পরে ফেলবেন যোগী আদিত্যনাথ।

গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের কথা যতই বলুন, মোদী কিন্তু তাঁর হিন্দুহৃদয়সম্রাটের ভাবমূর্তি বদলাতে চাননি। এখনও তিনিই মুখ, তিনিই মুখোশ।

বাজপেয়ী সম্পর্কে বিরোধীরা বলেছেন, তিনি ঠিক মানুষ, কিন্তু আছেন ভুল দলে। আবার তিনি নিজে নিউ ইয়র্কে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আয়োজিত জনসভায় বলেছেন, ‘‘আমি এক জন স্বয়ংসেবক। এক জন যে স্বয়ংসেবক, সে চির কালের স্বয়ংসেবক।’’

কোনটা রাজধর্ম আর কোনটা রাজনীতি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন