বাগডুবি গ্রামে তৃণমূলকে ভোট না দেওয়ার জন্য ‘শাস্তি’ বিধান করা হয়েছে ঠান্ডা মাথায়। —নিজস্ব চিত্র।
বিরোধিতার কণামাত্র চিহ্ন থাকবে না। ভিন্নমতের রেখামাত্র দেখা যাবে না। তেমন এক প্রয়াস আগের চেয়েও সংগঠিত ভাবে শুরু হয়েছে বলে প্রতীত হয়। ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত তেমনই বিশ্বাস করতে বলছে।
প্রথমে দেখা গিয়েছিল পঞ্চায়েত নির্বাচনের এক বেনজির মনোনয়ন পর্ব। এমনই বেনজির সন্ত্রাস যে, চার দশকের সব নজির চূর্ণ হল, ৩৪ শতাংশ আসনে বিরোধী দলের প্রার্থীই রইল না।
অরাজক মনোনয়ন পর্বেই যে শেষ নয়, সে বোঝা গিয়েছিল ভোটগ্রহণে। ভোটের দিন এবং আগের দিন-পরের দিন মিলিয়ে মৃত্যু আর বীভৎসতার উল্লাস দেখা গিয়েছিল সমগ্র বাংলা জুড়ে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
ভোট মেটার পরে বোঝা যাচ্ছে, এখনও শেষ হয়নি। বিরোধিতার জয় কোথায় কোথায় হয়েছে, বিরোধিতার প্রবণতা কোন কোন অঞ্চলে বেড়েছে— সব স্পষ্ট ফলাফলে। অতএব চিহ্নিত করে আক্রমণ শুরু এ বার। বর্বর আক্রোশে বিরোধিতার যাবতীয় অস্তিত্বকে দুমড়ে-মুচড়ে-পিষে ফেলার আয়োজন।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর থেকে বিস্ময়কর অভিযোগ আসছে। ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েতের দখল নিতে সন্ত্রাসের আয়োজন, কিন্তু অন্য পথে। শাসক দলের আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতী বাহিনী চড়াও হয় গ্রামে, গলা টিপে ধরে বিরোধিতার— এমনটাই আমরা দেখে এসেছি এত দিন। এ বার পুলিশ চড়াও হল। বিজেপির প্রতীকে জয়ী হয়ে পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছেন যিনি, তাঁর পরিজনদের বাড়িতে হামলা হল। মারধর-ভাঙচুর তো হলই। ঘরে থাকা অন্নের সংস্থানটুকুও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হল চালে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কী করার থাকে এই রকম অভিযোগ শোনার পর!
বিস্ময়ের আরও বাকি থাকে। কারণ মেদিনীপুর থেকে খবর আসে যে, বাগডুবি গ্রামে তৃণমূলকে ভোট না দেওয়ার জন্য ‘শাস্তি’ বিধান করা হয়েছে ঠান্ডা মাথায়। মহিলারাও ছাড় পাননি। শাসক দলের স্থানীয় কার্যালয়ের সামনে কান ধরে ওঠবোস করতে বাধ্য করা হয়েছে এক মহিলাকে।
আরও পড়ুন
জুতোর মালা পরিয়ে ঘোরানো হল দলীয় পঞ্চায়েত সদস্যের স্ত্রীকে, অভিযুক্ত তৃণমূলই
ভোট আসার আগে মনে হচ্ছিল, গলার চারপাশে সন্ত্রাসের যে ফাঁসটা চেপে বসছিল, সেটা নির্বাচনী সন্ত্রাসের ফাঁস। ভোটাভুটি পেরিয়ে যাওয়ার পর বোঝা যাচ্ছে, এ সন্ত্রাস থামবে না, এ সন্ত্রাস থামার নয়, এর কোনও শেষ নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসের মেঘটা ঘনিয়ে উঠেছিল ঠিকই। কিন্তু তা বলে নির্বাচন মিটে গেলে সন্ত্রাসও মিটে যাবে, এমনটা ভাবার আর কোনও কারণ নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই দফায় সন্ত্রাসের শুরুটা হয়েছিল সে ঠিক। আসলে সন্ত্রাস এবং অরাজকতা কায়েম করার একটা সুযোগ খোঁজা হচ্ছিল। প্রশাসনকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় রেখে অথবা প্রয়োজন মতো দুষ্কৃতীদের পক্ষে সক্রিয় করে তুলে যে নজির তৈরি করা হচ্ছে বা যে পথ দেখানো হচ্ছে, সেই পথ ধরে যে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-দুষ্কৃতীরা এ বার থেকে অবাধে যাতায়াত করবে বছরভর, তা নিয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
যে সন্ত্রাসে সওয়ার হয়েছেন শাসক, তা থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না। প্রশাসনের যে ফাঁক বা দুর্বলতা দেখে নিয়েছে দুষ্কৃতীরা-সমাজবিরোধীরা, সেই ফাঁক এ বার থেকে বছরভর ক্রিয়াশীল থাকবে। শাসকও সম্ভবত বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতি আর আগের মতো হবে না। কিন্তু এখন আর বুঝেও খুব বেশি কিছু করার নেই। যে ভাবে নিরপেক্ষতার নীতির বিসর্জন হয়েছে, যে ভাবে অনিরপেক্ষতা প্রশাসনিক মদত পেয়েছে, তাতে আইনের শাসন সক্রান্ত নীতির সমাধি রচিত হয়ে গিয়েছে।
অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে বাংলা আজ। শাসক উদ্বিগ্ন কি না সে কথা শাসকই ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু বাংলার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। যে সন্ত্রাসে সওয়ার হয়ে কোনও একটি দলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জয়যাত্রা চলছে আজ, সেই সন্ত্রাস ভবিষ্যতে সেই দলের দিকেই ফিরবে না, এমনটা কেউই আর জোর দিয়ে বলতে পারেন না। তবে জোর দিয়ে বলা যায়, এই মুহূর্তে সতর্ক হয়ে না গেলে সমপরিমাণ বা আজকের কয়েক গুণ সন্ত্রাস ফিরতে পারে শাসককুলের দিকে।