আউং সান সু চি।—ছবি রয়টার্স।
সকলেই বলিতেছেন, রাজার কাপড় নাই। রাজা বলিয়াছেন, উহার দরকার নাই। দেড় দশকের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে ক্ষমতায় আসীন হইয়া আউং সান সু চি-র ভোল বদলাইবার পরে সমালোচনার ঝড় বহিয়া যাইতেছে। শান্তি ও গণতন্ত্রের দূতের প্রতি মানবাধিকারের যে সর্বোচ্চ সম্মান অর্পণ করিয়াছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, তাহা ফিরাইয়া লইতেছে তাহারা। মায়ানমার সরকারও পত্রপাঠ জানাইয়া দিয়াছে, ওই পুরস্কারে তাহাদের প্রয়োজন নাই। সত্য। যে পন্থায় সরকার চলিতেছে, তাহাতে শান্তি ও গণতন্ত্রের দূত হইবার আকাঙ্ক্ষাটি যে সু চি-র মায়ানমার পোষণ করে না, ইহা স্পষ্ট। শাসক দলের পক্ষে মানবাধিকার হইতে অধিক প্রয়োজনীয় ধর্মীয় সংখ্যাগুরু এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন। সেই হিসাবে সুচারু রূপে আপন দায়িত্ব পালন করিতেছে এনএলডি। বহু ক্লেশ করিয়া ক্ষমতা অর্জন করিয়াছে তাহারা। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাহা হারাইলে শুষ্ক পুরস্কার লইয়া আর কী হইবে? সুতরাং, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তাহাদের বাস্তবতায় নিষ্প্রয়োজন।
ইতিহাস বলিবে, সু চি রাজনীতির বাঁধা গতে চলিতেছেন। শাসিতের অবস্থান হইতে তিনি দেশের ক্লেদ, গ্লানি বিশ্বের সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন। গৃহবন্দি থাকিয়া সংগ্রাম করিয়াছিলেন সেনাবাহিনীর দীর্ঘ অনাচারের বিরুদ্ধে। শাসক হইবার পরে শাসকের দায়িত্ব পালন করিয়াছেন ‘রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতা’। সু চি জানাইয়াছেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে ‘সেনার ভূমিকা সদর্থক’। শাসিত হইতে শাসকে রূপান্তরের পরিণামে এই অবস্থান পরিবর্তনই রাজনীতির পরিচিত ধারা। যিনি শাসিত, শাসন-মুক্তির উদ্দেশ্যে, সেই মুক্তির দাবিদার হিসাবে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার উদ্দেশ্যে সত্যকে তুলিয়া ধরিবার দায় তাঁহার থাকিতেই পারে। কিন্তু তিনি যখন ক্ষমতার আসনে বসেন, তখন সেই অবস্থান তাঁহার উপর অন্য দায় চাপাইয়া দেয়। তখন এমনকি অত্যাচারকে মান্যতা দিবার বাধ্যবাধকতাও আসিয়া পড়ে। অবস্থান বদল করিয়া সু চি এই ধারাই অনুসরণ করিয়াছেন।
এবং ন্যায়ের পথ হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছেন। মানবস্বভাব এবং মানবধর্ম এক নহে। ধর্মের একটি নৈতিক ভিত থাকে, সেই ভিত দুর্বল হইলে মানুষ ধর্মচ্যুত হয়। ক্ষমতার তাগিদে ধর্মচ্যুতি অতি পরিচিত। বস্তুত কখনও সেই অন্যায় করেন নাই, এমন রাজনীতিকের নিদর্শন পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত কম, হয়তো বিরল। কিন্তু প্রথমত, আদর্শের মূল্য তাহার নৈতিকতাতেই, ‘বাস্তব’ পৃথিবীতে তাহা কয় জন পালন করিতে পারিয়াছেন সেই অঙ্ক কষিয়া তাহার মূল্য স্থির করা যায় না। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার কারণে পথভ্রষ্ট হইলেও আত্মশুদ্ধির পথ কিন্তু সর্বদা খোলা থাকে, তেমন শুদ্ধির নমুনা ইতিহাসে সম্পূর্ণ বিরল বলা চলে না। দুর্ভাগ্যের কথা, সু চি-র আচরণে সেই আত্মশুদ্ধির কোনও তাগিদ দেখা যায় নাই। রোহিঙ্গাদের যন্ত্রণা ক্রমশ তীব্রতর হইয়াছে, তাঁহার নীরবতা ভাঙে নাই, যখন ভাঙিয়াছে তখনও তিনি কার্যত সেই যন্ত্রণার সাফাই গাহিয়াছেন। মানবাধিকারের বিশ্ববন্দিত প্রতিমা শেষ অবধি ইতিহাসের পাতায় একটি রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে আপন নাম মুদ্রিত করিয়া রাখিলেন, এই পরিণতি সুখের নহে।