বিস্মৃত: সাবিত্রী রায় (১৯১৮-৮৫)। ছবি ‘সাবিত্রী রায়ের নির্বাচিত রচনা-সংকলন’ (দে’জ) থেকে
১৯১৮’য় ঢাকায় জন্ম মেয়েটির। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হওয়ার পথে। সদ্য-তারুণ্যেই সে দেখেছিল গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে আর একটি বিশ্বযুদ্ধের ঘনিয়ে ওঠার ছায়া, যা রূপ নিচ্ছিল গ্রাম থেকে মহাজনের গোলায় ওঠা ধান শহরের গুদামে চলে যাওয়া, মন্বন্তর তৈরির পদ্ধতি, লোভের হাটে অভাবী মানুষদের মাংস বিক্রির মধ্যে। তার পর সেই মেয়ে দেখল দেশভাগ। দেখছিল আর লিখছিল সে। যেমন ভাবে লিখতে পারে ঘটনাপ্রবাহের ভিতরে থাকা এক জন সংবেদী মানুষ। সেই শুরু থেকে দাঙ্গা, তার রসায়ন, দেশভাগ, শেকড় উপড়ে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্তের এ পারে চলে আসতে বাধ্য হলেন, এক দিকে তাঁদেরকে দাবা বোড়ের মতো ব্যবহার করা রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীরা, অন্য দিকে সেই মানুষগুলোর টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা আর তার ওপর করাল ছায়া মেলে থাকা দেশেরই কিছু মানুষের লোভ, তারই মধ্য দিয়ে বাংলার এক নতুন সামাজিক উত্থান, এই সব কিছুকে লিখে চলেছিলেন সাবিত্রী রায়।
এই উপমহাদেশে ঘটতে থাকা সেই জন্মকালীন যন্ত্রণার অন্তরঙ্গ ছবি বাংলায় যাঁদের কলমে প্রথম অনুপুঙ্খ ফুটে উঠল তাঁরা দু’জনেই মহিলা। জ্যোতির্ময়ী দেবী আর সাবিত্রী রায়। এটা হয়তো স্বাভাবিক ছিল, কারণ দেশভাগ আর দাঙ্গার হাতফেরতা স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছিল মেয়েদের জীবনেই। শুধু শারীরিক অনিরাপত্তা বা লাঞ্ছনা নয়— যে সংসার তৈরি করে, পায়ের তলার মাটি সরে গেলে তার সমস্ত অস্তিত্ব টলমল করে ওঠে। তাকে প্রাণপণ খুঁজতে হয় সেই পরিবারকে ঝড়ের সমুদ্রে ভাসিয়ে রাখার উপায়। আর সেই সময়েও মেয়েদেরই সামলাতে হয়েছে পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ব, অসহযোগ, বিরোধিতা, যখন তাদের প্রয়োজন ছিল ঠিক উল্টোটা। সাবিত্রীর প্রতিটি উপন্যাসই বিশাল স্থান ও পাত্রে বিস্তৃত, কিন্তু তাদের মূল বিষয় যেন— কাল। সমকাল। তাঁর লেখা ব্যক্ত করছে কেবল দ্রষ্টার বর্ণন নয়, যাকে আগুনের আঁচ সহ্য করতে হয় তার কথন।
ঢাকায় জন্ম হলেও সাবিত্রী রায়ের শৈশব কেটেছিল তাঁর বাবার কর্মক্ষেত্র ফরিদপুর জেলার উপসি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নলিনীরঞ্জন সেন, মা সরযূবালা দেবী। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন বালিকা সাবিত্রীর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল বোধ হয় তার পিসিমা অম্বিকাসুন্দরীর। তিনি ছিলেন এক জন ঋজুচরিত্রের আদর্শবাদী মহিলা। সে কালের গ্রামীণ পরিবারে এমন মেয়েরা দুর্লভ ছিলেন না। পরিবারের ছোটদের ওপর এঁদের অধিকার ও প্রভাবও সাধারণ ভাবেই স্বীকৃত ছিল। তারাশঙ্করের কথা মনে পড়ে অবধারিত ভাবেই।
সাবিত্রীর দাদা ছিলেন তখনকার এক বিপ্লবী দলের সদস্য। তাঁর বন্ধু বিপ্লবী শান্তিময় রায়ের সঙ্গে সাবিত্রীর পরিচয় হয়। সে পরিচয় পরিণয়ে রূপ পায় ১৯৪০ সালে। তরুণটির মধ্যে বিপ্লবী আদর্শ ও জীবনযাত্রার প্রতি টান সাবিত্রীকে মুগ্ধ করেছিল। সমস্ত সামাজিক কুসংস্কারকে অগ্রাহ্য করে বিয়েতে এমনকি বধূর মাথায় সিঁদুর পরানোর আচারও বর্জন করেন বর। বিপ্লবী জীবনের কল্পনায় ভরপুর রোমান্টিক তরুণীটি ধাক্কা খান, যখন সেই মানুষই শ্বশুরালয়ে যাওয়ার জন্য সাবিত্রীকে পাল্কিতে বসিয়ে রওনা হন। সাবেক জমিদার পরিবারের সেই পালিতপুত্র মায়ের মনে কষ্ট দিতে পারবেন না বলে মেয়েটিকে ‘দেশের কাজ’-এ যোগ দেওয়ার বদলে ঘরের কাজের নিয়ম মেনেই চলতে বলেন। ইতিমধ্যে জেলখানায় কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শে এসে বামপন্থী পার্টিতে যোগ দেন শান্তিময়। যদিও পার্টিকর্মী অন্য মেয়েদের সঙ্গে তাঁর সহজ মেলামেশা ছিল, বাড়িতে মিটিং হলে সাবিত্রীর কিন্তু অন্য কোনও ভূমিকা ছিল না চা আর খাবারের বন্দোবস্ত করা ছাড়া। এই পর্যন্ত সবই ছিল ‘স্বাভাবিক’। পঞ্চাশ বছর পরেও এই একই ছকে অভ্যস্ত ছিলেন রাজনৈতিক কর্মীরা। সাবিত্রীর কাহিনি আলাদা হয়ে গেল, কারণ তিনি লিখতে শুরু করলেন, নিজের দৈনন্দিনের আনন্দ-হতাশা-আশাভঙ্গের কথা। বিলাপ করে নয়, শান্ত বস্তুনিষ্ঠতায়, যা কিছু তিনি সেই সময় নিজের চারিপাশে দেখতে পাচ্ছিলেন, সেই কথার মধ্যেই মিশে থাকছিল নিজস্ব অভিজ্ঞতার ব্যক্তিগত কথাও।
সৃজন আর ত্রিস্রোতা— প্রথম দু’টি উপন্যাসে আমরা দেখি স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলার সমৃদ্ধ গ্রাম-জনপদে রাজনৈতিক আন্দোলনের সেই ছবি, যা পাঠক অন্যত্র বিশেষ দেখেননি। বাঙালি গৃহস্থ পরিবারে নানা রকম মানুষের স্তর, বিশেষত মেয়েদের অসংখ্য চরিত্র ও তাদের বিচিত্র অবস্থান। বিচিত্র স্বভাব, সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত দ্বিধায় দীর্ণ অথবা আদর্শের আহ্বানে একনিষ্ঠ পুরুষচরিত্রের সংখ্যাও অনেক। সাবিত্রীর লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তাঁর আঁকা চরিত্রের সংখ্যাবহুলতা। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক, কারণ, আবার বলছি, দূর থেকে প্রবৃদ্ধ দর্শন নয়, যে কালকে তিনি অতিবাহিত করছেন, বাংলার ইতিহাসের সেই বিপুল তোলপাড়ের কালকেই লিখছেন সাবিত্রী। তা-ই তাঁর লেখার সবলতা ও দুর্বলতা। হাজং পাহাড় থেকে পূর্ব বাংলার মেঘনা-পদ্মা বিধৌত সমভূমি হয়ে কলকাতার উপকণ্ঠের বরানগর থেকে বির্জিতালাও, কাকদ্বীপ-সহ চব্বিশ পরগনা— এই বিশাল ভূখণ্ডের উপর দিয়ে চলা শতধারায় বহমান চল্লিশ-পঞ্চাশের দশককে এই ঔপন্যাসিক যে ভাবে, নিজের মন্তব্য যোগ না করে মূলত ঘটনা ও চরিত্রবহুলতা দিয়ে, ধরেছেন তাতে রাশিয়ান ক্লাসিক উপন্যাসের কথা মনে পড়তে পারে, বিশেষত ইলিয়া এরেনবুর্গের ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়ায় বিস্তৃত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গাথা দ্য স্টর্ম উপন্যাসের কথা।
অথচ আজকের পাঠকের কাছে প্রায় অজানিত এই ঔপন্যাসিকের নাম। তাঁর শেষ উপন্যাস ব-দ্বীপ ১৯৭২-এ প্রকাশিত, যদিও তা লেখা হয়েছিল আগেই। ১৯৮৫ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে, যখন এক জন সংবেদনশীল লেখকের সৃষ্টিশীলতা ও ভাবনা সবচেয়ে পরিণত হওয়ার কথা, সেই সময় থেকে জীবনের শেষ ষোলো বছর শুধু তিনটি উপন্যাসের খসড়া করেছিলেন বলে জানাচ্ছেন তাঁর কন্যা। কেন? বাংলা উপন্যাসের আগ্রহী পাঠক হিসাবে, এক জন সামান্য লেখিকা হিসাবে, আমাদের শক্তিময়ী পূর্বমাতৃকার এই মৌন আমাদের মনে উত্তর পাওয়ার গভীর ব্যাকুলতা তৈরি করে। এবং এইখান থেকেই উঠে আসে অস্বস্তিজনক কিছু সঙ্কেত। সাবিত্রীর ত্রিশ বছর বয়সে তৎকালীন বাংলার সবচেয়ে বড় সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন তেভাগা ছিল তাঁর স্বরলিপি উপন্যাসের বিষয়। এই উপন্যাস সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক দলের সেন্ট্রাল কমিটি এমন কঠোর মনোভাব নেন, যা বোধ হয় অন্য কোনও বাংলা উপন্যাসের ভাগ্যে জোটেনি। লেখিকা পার্টি সদস্য ছিলেন না, তাঁকে ওই বই লেখার জন্য ‘নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা’ করতে বলা হয়। বইটি পাঠ করা নিষিদ্ধ করা হয়। তাঁর স্বামী পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে ফিরেও আসেন, কী শর্তে জানা যায় না। জানা যায় না সাবিত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে এই ঘটনার অভিঘাত।
কী ছিল স্বরলিপিতে? সাধারণ কর্মীদের আত্মোৎসর্গের বিপরীতে কলকাতায় বিলাসী জীবন কাটানো এক নেতার কথা। হয়তো সাবিত্রী তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সাধারণ কর্মীদের দিনের পর দিন পার্টির জন্য নিজেদের জীবন তুচ্ছ করা ত্যাগ ও ভালবাসা দেখাই হয়তো তাঁকে একান্ত বাধ্য করেছিল দ্রষ্টা হিসাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে। সাবিত্রী রায়ের বিষয়ে কথা হলে দীর্ঘকাল কেবল এই বিষয়টিই বার বার সামনে এসেছে। কিন্তু, নতুন করে তাঁর লেখা পড়তে পড়তে বেশ কিছু কথা খেয়াল করছিলাম। মাত্র ছাব্বিশ কী আঠাশ বছর বয়সের লেখাতেও ক্ষমতার চরিত্র কত স্পষ্ট খেয়াল করতে পারেন এই লেখিকা— পার্টির নেতা রমেন রায় শ্রমিকসভায় নিজের ভাষণ শেষ করে অন্যের কথা না শুনে বেরিয়ে যান ‘দরকারি কাজ’-এ। আধঘণ্টা পর তাঁকে দেখা যায় চায়ের দোকানে অন্যদের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন। পার্টিকর্মী যে শহুরে মেয়েরা মিটিংয়ে আসেন, তাঁরা কিন্তু কথা বলেন না নায়কের স্ত্রী, শান্ত শিক্ষিত বধূটির সঙ্গে। ছোট থেকে বড় অসংখ্য অলিন্দে ক্ষমতার এই চেহারা সাবিত্রীর কাছে তখনই পরিষ্কার দেখা দেয়, যা উত্তরকালে সংগঠনের প্রধান সঙ্কট হয়ে উঠেছিল। আজ মনে হয় এমন স্পষ্ট সরল বিবরণে কি নিজের বিপদ আরও গভীর করে তোলেননি সাবিত্রী? তাই কি চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান সামাজিক বিবরণদাত্রীর লেখা এমন নৈঃশব্দ্যের অন্তরালে চলে গেল, যেন তা ছিলই না কখনও। জানতে ইচ্ছে হয় কেমন হত তাঁর কলমে লেখা আত্মদানের সত্তর?
মেঘনা-পদ্মা, পাকাধানের গান, মালশ্রী, ব-দ্বীপ— তার পর কোনও গভীর যন্ত্রণায়, কোনও অভিমানে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে প্রায় নীরব হয়ে যাওয়া এই নারী লেখিকাকে কি আবার আদর করে পড়বে তাঁর উত্তরপ্রজন্ম? এক দামাল সময়ের অতুলন ধারাবিবরণী হিসাবে?
সময় হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল বিস্মৃতির অবহেলায় পার হয়ে গেল সময়লেখার এই কথকের এক শততম জন্মদিন।