রাম-অর্জুন-একলব্যের দেশে বাহুবলীর আবাহন! তাঁকে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার নতুন ব্র্যান্ড অ্যামবাসাডর বললেও ভুল হয় না। ১২০ কোটির দেশে খেটে খাওয়া গরিব ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্তের (স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে) ফ্যান্টাসি-পুরুষ তিনি। এখন ‘ফ্যান্টাসি’ শব্দটার মধ্যে, একটি বিশেষ ধরনের আমোদ আছে, আবার বিষয়টিকে লঘু করে দেখার প্রবণতাও। তবে বাহুবলীকে ঘিরে আসমুদ্র হিমাচলের উন্মাদনা যা কালে কালে উৎসবে পর্যবসিত হয়েছে, তা কিন্তু ঘোর বাস্তব। তার থেকেও বড় সত্যি ইন্ডিয়ার ব্র্যান্ড পুজোর রমরমা। জামা-কাপড়-জুতো থেকে শুরু করে ব্যক্তিও এখন ব্র্যান্ড। জাতীয় রাজনীতিতে তার নিদর্শন ভূরি ভূরি। সেই ব্র্যান্ড-সচেতন ভারতবাসীর কাছেই দক্ষিণী পরিচালক এস এস রাজামৌলির উপহার বাহুবলী। যিনি একাধারে বীর ও ব্র্যান্ড, ফ্যান্টাসি ও বাস্তব, রেট্রো ও ইউবার সেক্সুয়াল।
প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, কে এই বাহুবলী? ইতিহাস তো এত কাল এঁর সঙ্গে পরিচয় করায়নি। উইকিপিডিয়া বলছে, জৈনদের প্রথম তীর্থঙ্কর আদিনাথের পুত্র বাহুবলী। জৈন গ্রন্থ আদি পুরাণ অনুসারে, ঋষভনাথ তাঁর এক পুত্র ভরতকে দেন বিণীতা রাজ্য (অযোধ্যা)। আর বাহুবলীকে দেন অস্মক(দক্ষিণ ভারত)। ছবিতে বাহুবলীর অন্য পরিচয় থাকলেও তিনি দক্ষিণের ধ্বজাধারী, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। উত্তরের রাম-রাজ্যপাটে তাঁর এই শক্তিশালী আবির্ভাব তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর নামই তাঁর পরিচয়ের ধারক ও বাহক। তিনি মহাপরাক্রমশালী বীর। বাহুবলে তিনি একটি শিবলিঙ্গকে কাঁধে তুলে ফেলতে পারেন। তিনি ধনুর্ধর, তিরন্দাজ, শস্ত্রবিদ্যার কোনও কিছুই তাঁর অজ্ঞাত নয়। সেলুলয়েডে এমন এক জন বীরের চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য টানা পাঁচ বছর ১০০ কেজিরও বেশি ওজনের শরীরটিকে লালন-পালন করেছেন দক্ষিণী নায়ক প্রভাস। তাঁর চওড়া কাঁধ, নির্মেদ প্যাকস, সুঠাম পেশি এবং সুবৃহৎ অবয়ব দেখে মহিলাদের ফ্যান্টাসি জাগারই কথা। কিন্তু তিনি পুরুষেরও ফ্যান্টাসি। কারণ, ভারতীয় পুরুষের কাঙ্ক্ষিত চেহারা এটাই।
ভারতীয়দের মধ্যে বীর-পুজোর একটি বিশেষ অভ্যেস ছোটবেলা থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয়। বীর মানেই শুধু পরাক্রম তা কিন্তু নয়। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন, এটাই বীরের ধর্ম। আর বীরত্বের সঙ্গে বুদ্ধির কোন বৈরিতা নেই। বাহুবলীর মধ্যে কিন্তু এই সবক’টি গুণ পাবেন। তবে বাহুবল একটু বেশিই পাবেন। আর তার জোরেই বাহুবলী শুধু বীরপুজোয় আটকে নেই। তিনি এখন ব্র্যান্ড। ব্র্যান্ড ভিএফএক্স। ব্র্যান্ড সেক্সুয়ালিটি। ব্র্যান্ড ধর্ম।
বাহুবলীর ধর্ম রাজধর্ম। তাঁর মায়ের শেখানো নীতিবোধের ধর্ম। ঠিক-ভুল ভেদাভেদের ধর্ম।. জন্মভূমিকে সুরক্ষিত রাখার ধর্ম। প্রজাদের নিরাপদে রাখার ধর্ম। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধানও কিন্তু সেই ধর্মের কথাই বলেন। মাতৃভূমির জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ। বাহুবলের আস্ফালন করতে না পারলেও তাঁর ছাতি ৫৬ ইঞ্চি। তবে বাহুবলীর রাজতন্ত্রের সঙ্গে ভারতের গণতন্ত্রের একটা বড় ফারাক আছে। গণতন্ত্রে তো কোনও রাজা নেই। তাই এ কথা বলার সাহস কেউ রাখেন না, যে ‘আমার বচন আমার শাসন।’ নিন্দুকেরা তো হামেশাই বলেন, ভারতীয় রাজনীতিকরা নিজেদের কথা রাখেন না। আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেও ভোটাভুটি করেই নিজের কথা কাজে বাস্তবায়িত করাতে হয়।. ইভিএমে কারচুপির উপায় তবু বাতলে দেওয়া যায়। কথার কারচুপি ধরতে গেলে জন্ম নেয় আরও অনেক কথা। গণতন্ত্র তাই কথার রাজনীতি করে।
বাহুবলের প্রয়োগও গণতন্ত্রে আইন মেনে করতে হয়। সেই গণতন্ত্রে যখন কোনও মহিলাকে আপত্তিজনক ভাবে কোনও পুরুষ স্পর্শ করেন, মহিলা অভিযুক্তের আঙুল কেটে দেবেন সেটাও শিক্ষিত সমাজের কাছে কাম্য নয়। তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ শুধু বাহুবলীই করতে পারেন। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে গণতন্ত্রে আদালত আর থানার চক্কর কাটতে হয়। আরও নানা হয়রানি পোহাতে হয়। তা হলে এখানে বাহুবলী ফ্যান্টাসির অতিরিক্ত কিছু হয়ে উঠল না। তবে এ কথাটা না বলে পারলাম না, প্রেক্ষাগৃহে ওই দৃশ্যটিতে সব চেয়ে বেশি হাততালি পড়েছিল।
তা হলে আম ভারতবাসী কী পাচ্ছে এই ছবি দেখে? কিসের তরে গাঁটের কড়ি বার বার খরচ করে দিনের তিনটি ঘণ্টা ব্যয় করা? বুদ্ধি-যুক্তি-নীতির কচকচানিতে সব সমস্যার সমাধান তো হয় না। বাহুবলেই যদি সমস্যার ঘাড় মটকে দেওয়া যায়, সেটুকু ‘অবসেশন’ রাখতে দোষ কী?