উদ্বেগজনক

নূতন জমানার অনলাইন বিনোদনের প্ল্যাটফর্মকে টপকাইয়া, সৌন্দর্যবর্ধক সাবান, জীবাণুনাশক তরল, দন্তরুচিকৌমুদীরক্ষক মাজনকে পিছনে ফেলিয়া এক নম্বরে ভারতীয় জনতা পার্টি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

নূতন জমানার অনলাইন বিনোদনের প্ল্যাটফর্মকে টপকাইয়া, সৌন্দর্যবর্ধক সাবান, জীবাণুনাশক তরল, দন্তরুচিকৌমুদীরক্ষক মাজনকে পিছনে ফেলিয়া এক নম্বরে ভারতীয় জনতা পার্টি। নভেম্বরের ১০ হইতে ১৬ তারিখের সপ্তাহে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের সংখ্যার হিসাবে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে নয় হাজারেরও বেশি গোলে হারাইয়াছে বিজেপি। তথ্যটিকে হাসির খোরাক বানাইয়া লওয়া যায়— আহা, এক রাজনৈতিক দল প্রচারের খেলায় ভোগ্যপণ্যকে গোহারান হারাইতেছে! সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই হাসি আরম্ভও হইয়াছে। কিন্তু, সেই লঘুতায় ভাসিয়া গেলে সংবাদটির মূল তাৎপর্য হারাইয়া যায়। সংবাদটি ‘ট্রিভিয়া’ নহে, ইহাই মোদী-জমানায় বিজেপির রাজনীতির মূল ধারা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে নিজের ভাবমূর্তি পাল্টাইতে, গুজরাত দাঙ্গার স্থপতি হইতে জনমানসে নিজেকে ‘বিকাশপুরুষ’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিতে নরেন্দ্র মোদী দেশের সেরা বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের নিয়োগ করিয়াছিলেন। আন্তর্জাতিক জনসংযোগ সংস্থাকে ডাকিয়া আনিয়াছিলেন। তাহাতে কী বিপুল লাভ হইয়াছে, সেই হিসাব নরেন্দ্র মোদীরা বিলক্ষণ জানেন।

Advertisement

ফলে, এই দফাতেও যে তাঁহারা বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করিবেন, তাহা স্বাভাবিক। এবং, দূষণীয়ও নহে। যদি বিজ্ঞাপনবাবদ ব্যয় করা অর্থ কৃষ্ণবর্ণ না হয়, এবং তাহা রাজকোষ হইতে উৎসরিত না হয়, তবে কোন দল বিজ্ঞাপন খাতে কত টাকা ব্যয় করিবে, তাহা নিতান্তই দলের বিচার্য। নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রচার অপরিহার্য। কোনও দল টেলিভিশন বা অনলাইন মাধ্যমকেই প্রচারের প্রধান পরিসর ভাবিলে আপত্তির কারণ নাই। কেহ বলিতে পারেন, বিজেপির এই বিপুল প্রচারের বড় অংশ জু়ড়িয়া আছে অর্ধসত্য এবং মিথ্যা। প্রথমত, সেই দোষে একা বিজেপি দুষ্ট নহে— যে কোনও বিপণনই সংশ্লিষ্ট পণ্যকে বাড়াইয়া চড়াইয়া বেচিতে চাহে। বিজেপি তাহার রাজনীতিকে গণভোগ্য পণ্যের স্তরে নামাইয়া আনিয়াছে, এইমাত্র। এবং দ্বিতীয়ত, বিজেপির মিথ্যা প্রচারের ফানুসটিকে মাটিতে নামাইয়া আনিবার দায়িত্ব বিরোধীদের। সেই কাজে তাঁহারা ব্যর্থ, তাহার দায় বিপণনের ঘা়ড়ে চাপাইলে মুশকিল।

বিজ্ঞাপনী প্রচারে এই বিপুল ব্যয়বরাদ্দে মূল উদ্বেগের কারণটি অন্যত্র। নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সহিত পারতপক্ষে কথা বলেন না। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন না, হাতে গোনা ব্যতিক্রম বাদে কোনও সাংবাদিককে সাক্ষাৎকারও দেন না। সাধারণ মানুষের নিকট নিজের বার্তা পৌঁছাইয়া দিতে তাঁহার পূর্বে দলমতনির্বিশেষে সকল রাজনীতিকই গণমাধ্যমের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সেই তোয়াক্কা করেন নাই। এক দিকে সোশ্যাল মিডিয়া, আর অন্য দিকে বিজ্ঞাপন, মানুষের নিকট পৌঁছাইবার জন্য তিনি এই দুই পথের পথিক। প্রযুক্তি (এবং, আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ ‘বন্ধু’রা) তাঁহার সহায়ক হইয়াছে। রাজনৈতিক ভাবে অতি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কারণ, প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে মানুষের নিকট পৌঁছাইতে হইলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এবং, সব সাংবাদিক পূর্বনির্দিষ্ট প্রশ্নেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখিতে সম্মত নহেন, তাঁহারা অপ্রিয় প্রশ্ন করিতে চাহেন। সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনের রণপায়ে ভর দিয়া নরেন্দ্র মোদী এই অপ্রিয় প্রশ্নের চোরাবালিটিকে সাবলীল ভাবে টপকাইয়া গিয়াছেন। এই পরিসরে তাঁহাকে প্রশ্ন করিবার, ভুল ধরাইয়া দেওয়ার কেহ নাই। সত্য-মিথ্যা নির্বিশেষে তাঁহার কথা মানুষের নিকট পৌঁছাইতেছে। এবং, প্রচারের প্রাবল্যে তাহা বিশ্বাসযোগ্যও হইতেছে। ইহা গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। ঠিক এই কারণেই বিজেপির বিজ্ঞাপনী ব্যয় পরিহাসের নহে, উদ্বেগের বিষয়। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ লইয়া উদ্বেগ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন