আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত মহড়া: উত্তরপ্রদেশের দুইটি উপনির্বাচনকে এই আখ্যা দিয়াছিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, অবশ্যই ভোটের ফলাফলের আগে। ফলের রকম দেখিয়া তিনি এখন ভাবিতেছেন, কেন মুখ ফসকাইয়া এত কথা বলিতে গেলেন! গোরক্ষপুর ও ফুলপুরে ‘অঘটন’ ঘটাইয়া সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজবাদী পার্টির বিপুল জয় রাজ্যে ও কেন্দ্রে সরকারের ঘুম কাড়িয়া লইতেছে। স্পর্ধিত স্বরে বলিলেও কথাটা ঠিকই বলিয়াছিলেন আদিত্যনাথ। ইহা তো কেবল দুইটি সাধারণ উপনির্বাচন ছিল না। যে আসন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং খালি করিয়া আসিয়াছেন, যে আসনে তিনি একাদিক্রমে জিতিয়া লোকসভায় পাঁচ বার প্রতিনিধিত্ব করিয়াছেন, মুখ্যমন্ত্রী হইবার এক বৎসরের মধ্যে সেখানে তাঁহার দল গোহারা হারিলে ঘটনার একটি বিশেষ অর্থই দাঁড়ায়। অন্য আসনটিও খালি হইয়াছিল উপ-মুখ্যমন্ত্রীর কারণে। সুতরাং সেখানেও লজ্জা ঢাকিবার জায়গা নাই। বিজেপি সব রকম চেষ্টা চালাইয়া গিয়াছে, গোঁজ-প্রার্থী দিয়া এসপি-বিএসপি ভোটাঙ্কে খাবল মারিবার চেষ্টাও করিয়াছে। ফল হয় নাই। বস্তুত মুসলিম গোঁজ-প্রার্থী ফুলপুরে আটচল্লিশ হাজার ভোট না পাইলে বিজেপির পরাজয়ের ব্যবধান কোথায় গিয়া ঠেকিত, ভাবিতেও শিহরন হয়। উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘ওয়েভ’ তুলিবার পরই এই সম্মানহানিতে মোদী নিশ্চয় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি উষ্ণতা রাখিতে পারিবেন না। তাঁহার শীতল-কঠিন নীরবতাই বলিয়া দিতেছে, বিজেপি ভাল নাই। প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর সমীকরণও সুবিধাজনক জায়গায় নাই।
বিরোধীদের জয়কে ছোট করিয়া দেখাইতেই হয়— রাজনীতির দস্তুর। সুতরাং অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর সন্ধির মধ্যে কতটা সুবিধাবাদিতা, কত নড়বড়ে তাঁহাদের জোট, কত পশ্চাদপর এই সংকীর্ণ স্বার্থভিত্তিক অঙ্ক, ইত্যাকার অভিযোগের বন্যা। সত্য কথা, দলিত ভোটকে কী ভাবে ‘ট্রান্সফার’ বা স্থানান্তর করিয়া ভোটের ফলে পরিবর্তন আনা সম্ভব, আবারও সেই অঙ্কে পারদর্শিতার প্রমাণ রাখিলেন মায়াবতী। ওবিসি, বিশেষত যাদব সম্প্রদায়ের সহিত দলিতদের সম্পর্ক টালমাটাল, ফলে ভবিষ্যতে সমস্যার সম্ভাবনাও রহিল। তবু বিজেপির অভিযোগে এক শিশুসুলভ সারল্য আছে। সুবিধাবাদিতা, অঙ্কের হিসাব, সংকীর্ণ স্বার্থের চর্চা, এই সমস্ত ‘গুণাবলি’ই কি বিজেপির রাজনীতিরও বৈশিষ্ট্য নয়? মাত্র কিছু দিন আগেই উত্তর-পূর্বে বিজেপির নির্বাচন-কৌশল মনে করা যাইতে পারে। কেবল অমিত শাহই এই গুণাবলি-র ভিত্তিতে ভোটতরণি পারে ভিড়াইলে তাহা ‘ওয়েভ’, আর অন্যরা একই কৌশলে জিতিয়া গেলে তাহা দুর্নীতি?
উত্তরপ্রদেশের ফলাফল বরং বুঝাইয়া দিল, ভারতীয় সমাজের মধ্যে কত বিচিত্র রাজনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা লুকাইয়া। নানাবিধ স্বার্থ ও সত্তাবোধে বিভক্ত সমাজে রাজনৈতিক জয়-পরাজয় অনেকাংশেই কৌশল ও অঙ্কের হিসাবের প্রশ্ন। বিজেপির মতো বৃহৎ ও সুসংগঠিত দল না হইয়াও সেই হিসাব মিলানো যায়, বহু স্বার্থকে এক মঞ্চে আনা যায়। যে দল আজ অপরাজেয়, মাত্র এক বৎসর পরই সেই দলের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ চুন করিয়া দেওয়া যায়। রাজনীতি একটি সম্ভাবনার শিল্প। আর ভারতের মাটিতে— রাজনীতি অসম্ভবকেও সম্ভব করিতে পারার উপযুক্ত শিল্প। অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর ভোট-বোঝাপড়ার জোর আসিয়াছে দুই দলের সমর্থক সমাজ হইতে, যাঁহারা বিজেপির বিরুদ্ধে তিতিবিরক্ত, বিক্ষুব্ধ। ফলে শেষ বিচারে, বিজেপির পরাজয়ে বিজেপির ‘কৃতিত্ব’ই সর্বাধিক। স্বেচ্ছাচার ও দমনপীড়ন দিয়া নিজেদের বিরুদ্ধতার বলয় তাঁহারা অনেক দূর প্রসারিত করিয়াছেন। বিভিন্ন অক্ষের বিরোধীদের মিলিত হইবার অবকাশটিও তৈরি করিয়া দিয়াছেন।