প্রবন্ধ

দেখো তো চিনতে পারো কি না

দুর্নীতি রোখা অসাধ্য নয়। নারদা-সারদা জর্জরিত এই রাজ্যেও প্রায় রাতারাতি চুরি-প্রতারণা রুখে দেওয়া যায়। রেশন ব্যবস্থার ভোলবদল সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।তালুতে জ্বালা-ধরানো রাগ। তিতকুটে বিরক্তি। কষাটে হতাশা। গা গুলিয়ে-ওঠা ভয়। এই তো খবরের নিত্যকার মেনু। সেখানে যদি হঠাৎ পাতে পড়ে মিঠে বিস্ময়, চোখ কপাল বেয়ে উঠতে চায়। আরে, এমনও হয় নাকি? এই দুর্ভাগা রাজ্যে?

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০০:০০
Share:

নকশা বদল। বালুরঘাটে ২২ এপ্রিল, ২০১৫ নয়া প্রকল্পের শুরু। ছবি: অমিত মোহান্ত

তালুতে জ্বালা-ধরানো রাগ। তিতকুটে বিরক্তি। কষাটে হতাশা। গা গুলিয়ে-ওঠা ভয়। এই তো খবরের নিত্যকার মেনু। সেখানে যদি হঠাৎ পাতে পড়ে মিঠে বিস্ময়, চোখ কপাল বেয়ে উঠতে চায়। আরে, এমনও হয় নাকি? এই দুর্ভাগা রাজ্যে?

Advertisement

হয় বইকী। পশ্চিমবঙ্গে এখন আগের চাইতে রেশন ব্যবস্থা অনেক ভাল কাজ করছে। রেশন ডিলাররা সবাই সেই একই লোক, অথচ রেশন পরিষেবা আর চেনা যাচ্ছে না। একই স্বর্ণ চাল দেওয়া হচ্ছে, অথচ পচা, পোকা, দাগ-ধরা চাল পাওয়া নিয়ে অশান্তি নেই বললেই চলে। দু’টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল-গম পাওয়ার লোক দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কিন্তু রেশন না পেয়ে খালি ব্যাগ হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে, এমন নজির চোখে পড়ছে না। বরং সকাল-বিকেল দু-তিন ঘণ্টা বেশি সময় খোলা থাকছে রেশন দোকান, কখনও বাড়তি একটা বেলা, কিংবা একটা গোটা দিনও।

যে সব ডিলার-গ্রাহক এত দিন ছিল আদায়-কাঁচকলায়, এখন তারাই যেন মোচা-নারকোল। লুকিয়ে (কিংবা খোলাখুলি) বাজারে রেশনের চাল-গম বিক্রি, চিরকাল যে অভিযোগ উঠেছে রেশন ডিলারদের বিরুদ্ধে, এখন কান পেতেও তা শোনা যাচ্ছে না। বরং উদ্বৃত্ত চাল-গম গ্রাহকই বিক্রি করছেন বাজারে (চাল ১৪-১৬ টাকা, গম ১০-১২), তা ‘ওপেন সিক্রেট।’

Advertisement

কেন্দ্রের খাদ্য সুরক্ষা আইন, আর সেই সঙ্গে ‘রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা’, ‘খাদ্যসাথী’ প্রকল্প শুরুর পর গণবণ্টন কতটা বদলে গিয়েছে, বুঝতে হলে তাকাতে হয় বাঁকুড়ার ইন্দাস, বড়জোড়া, সোনামুখীর দিকে। ২০০৭-এ এই সব এলাকায় গমের দাবিতে বিক্ষোভের আগুন জ্বলেছিল, ছড়িয়ে গিয়েছিল রাজ্যের নানা জেলায়। ডিলারদের বাড়ি ঘেরাও, গুদাম লুট, বস্তা টেনে ফেলে দেওয়া পুকুরের জলে— ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের সামলাতে হিমশিম খেয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম-বিপর্যয়ের সে-ই ছিল পূর্বাভাস। বড়জোড়ার তাজপুর গ্রামের শেখ আইনাল বলেন, ‘‘সে দিনের ছবিটা আজও চোখে ভাসে। গোটা গ্রাম ডিলারের বাড়ি ঘেরাও করেছিল।’’ আর এখন? ‘‘চাল-গম দু’টাকা করে পাচ্ছি, আর কোনও ক্ষোভ নেই।’’

ইন্দাস থেকেই শুরু হয়েছিল সেই বিক্ষোভ। ইন্দাসের রেশন গ্রাহক শ্রীকান্ত মাঝি বললেন, ‘‘এখন ভাবতে অবাক লাগে, এপিএল-এর বরাদ্দ অত সামান্য গম, সে দিন তা-ও পাইনি।’’ খাদ্যসাথী প্রকল্পে তাঁর পরিবারে এখন আটটা কার্ড, সপ্তাহে ছ’কেজি গম পান শ্রীকান্ত। দরকার মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকছে মাসে ৮-১০ কেজি।

‘‘এমন যদি আগে হত, বাবাকে চলে যেতে হত না,’’ দুঃখ করছিলেন রেশন ডিলার অমিত পাল। ২০০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাইপুরের মটগোদার ডিলার নির্মলচন্দ্র পাল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। গ্রাহকদের চাপ সহ্য হয়নি তাঁর। তাঁর ছেলে অমিত বললেন, ‘‘এখন মাল প্রচুর আসছে, দীর্ঘক্ষণ বিলি করছি।’’

চাহিদা এখন এমন চ়ড়া, যে শস্য আর মজুত করে রাখা যাচ্ছে না। ঢুকছে আর বিলি হচ্ছে। পচা, দাগ-লাগা, পোকা-ধরা চাল আর নেই। তাজা চাল পেয়ে খুশি ক্রেতারা। নদিয়ার বেথুয়াডহরির গ্রাহক ক্ষিতীশ মণ্ডল বললেন, ‘‘আগের চাইতে অনেক ভাল চাল আসছে।’’ তাই মধ্যবিত্তও আর ছাড়তে চাইছেন না নিজের বরাদ্দ। রেশনের দোকানের সামনে লাইন লম্বা হচ্ছে।

কিন্তু এই বাড়তি চাপে তো রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কথা। আগে যেখানে ৩ কোটি ২০ লক্ষ বিপিএল গ্রাহক অতি শস্তায় চাল-গম পেতেন, সেখানে এখন পাচ্ছেন প্রায় সাত কোটি। বিশেষত ‘খাদ্যসাথী’ প্রকল্পটি কার্যত রেশন ব্যবস্থাকে ‘যে চাইবে সে-ই পাবে’ ভিত্তিতে নিয়ে এসেছে, একশো দিনের কাজের প্রকল্পের ধাঁচে। রান্নার গ্যাসের মতোই, যাঁরা স্বেচ্ছায় ভর্তুকি নিতে চান না, তাঁরাই কেবল এখন রেশনের বাইরে। আগের চাইতে এখন মাসে এগারো লক্ষ টন বাড়তি খাদ্যশস্য বিলি করছে রাজ্যের হাজার কুড়ি রেশন দোকান। নদিয়ার কৃষ্ণনগর-লাগোয়া গোবরাপোতা বাজার এলাকার ডিলার নন্দদুলাল রায় জানালেন, এপিএল-বিপিএল মিলিয়ে তিনি আগে সপ্তাহে ৩১ কুইন্টাল গম, ৯৬৫ কেজি চাল বিলি করতেন। এখন করেন ৫৩ কুইন্টাল গম, আর ৩৪ কুইন্টাল চাল।

এপিএল গ্রাহকদের মাথাপিছু স্রেফ ২৫০ গ্রাম গম দিতে গিয়ে যে পরিষেবা ভির্মি খেত, আজ তা-ই কী করে অকাতরে পাঁচ কেজি বিলি করছে? করছে, কারণ বদলে গিয়েছে নকশাটা। যে কোনও প্রকল্পের কার্যকারিতা যে আদতে নির্ভর করে তার নকশার উপর, পশ্চিমবঙ্গের রেশন ব্যবস্থা তা ফের প্রমাণ করল। নকশার গলদই দুর্নীতি, অপচয়, মন্দ মানের সুযোগ করে দিয়েছিল। এমনকী, এগুলো অবধারিত করে তুলেছিল। নকশা বদলেছে এমন ভাবে, যে এখন রেশনের গম আর বাজারে বিক্রি করা যাচ্ছে না, একান্তে বলছেন ডিলাররাই।

প্রথমত, কে কী পাবে তা একেবারে সহজ হয়ে গিয়েছে। ‘এপিএল’ নেই, শিশুদের হাফ-বরাদ্দ নেই। সবাই মাথাপিছু পাঁচ কেজি। গ্রাহকদের ছোট একটি অংশ ছাড়া (রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা ২) সকলের জন্য এক দাম, দু’টাকা। ভাঁওতার সুযোগ নেই। স্পষ্ট প্রত্যাশা, স্পষ্ট প্রাপ্তি।

দ্বিতীয়ত, বরাদ্দে অনিয়ম আর নেই। আগে এপিএল-এর বরাদ্দ সব সপ্তাহে আসত না। গ্রাহক ধাঁধায় থাকত, সত্যি গম আসেনি, নাকি ডিলার মিথ্যে বলছে।

তৃতীয়ত, ৯ টাকা কেজি গম নিতেন না অনেকে। সামান্য বেশি দরে বাজারে ভাল গম মিলত। উদ্বৃত্ত এপিএল গম বাইরে বিক্রি হত। রেশনে দুর্নীতির বেশিটাই ছিল এখানে। একটি সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট ছিল, গোটা দেশে রেশনের ৪৭ শতাংশ শস্যই বিক্রি হচ্ছে বাইরে। এখন গমের পরিমাণ, দাম, পাওয়ার নিশ্চয়তা, সব স্পষ্ট। গ্রাহক হকের গম ছাড়ছেন না। উদ্বৃত্ত বিক্রির সুযোগ প্রায় নেই।

স্পষ্টতার এই শক্তি দেখা গিয়েছে অন্য ক্ষেত্রেও। স্কুলে গেলেই দুপুরের ভাত-ডাল মিলবে, তার দায়িত্ব শিক্ষকদের— এই সরল শর্তের জন্য মিড ডে মিল প্রকল্প সফল হয়েছে। মান খারাপ হলে, খাওয়া অনিয়মিত হলে শিক্ষকদের কাছে ক্ষোভ জানান অভিভাবকরা। তাতেই কাজ হয়। তুলনায় অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে আজও খারাপ খাবার, অনিয়মিত পরিষেবা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের অভিযোগ। তার অন্যতম কারণ, এই প্রকল্পের বিন্যাস জটিল। কে এর দায়িত্বে, প্রশ্ন করলে গ্রামের মানুষ কখনও বলেন ‘খাদ্য’, কখনও ‘বিডিও’। সুপারভাইজার, সিডিপিও গ্রামবাসীর নাগালের বাইরে। কাকে নালিশ জানাবেন তাঁরা? যে কোনও সরকারি প্রকল্পের সুবিধে থেকে মানুষকে বঞ্চনা করার সহজতম উপায় বিচিত্র, বোঝার-অসাধ্য শর্ত তৈরি করা। গণবণ্টন তার থেকে মুক্তি পেয়েছে বলে রাজ্যের মানুষ বেঁচে গিয়েছে।

তা হলে কি দুশ্চিন্তার কিছু নেই?

আছে বইকী। চালে ভর্তুকির জন্য রাজ্যের খরচ আগে ছিল শূন্য। এখন বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় সবটাই পাচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের সমীক্ষায় ‘দরিদ্র’ নন। কিছু গরিব হয়তো বাদ গিয়েছিলেন। কিন্তু দু’টাকা কেজি শস্য না হলেও যাঁদের অপুষ্টি হত না, ‘খাদ্যসাথী’-র অধীনে এমন লোকই বেশি। এপিএল গম না মেলায় বিক্ষোভের যে ধাক্কা খেয়েছিল বামফ্রন্ট, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে মমতা পয়লা রাতেই বেড়াল মেরেছেন। রেশনের চাল ভোটের ভাতে বাড়বে, কিন্তু রাজ্যের ভাঁড়ারে খাবলা হবে গভীর।

প্রশ্ন পুষ্টি নীতি নিয়েও। ভারতে এক বছর বয়সের পরেই অপুষ্টি শুরু হয় শিশুদের, তীব্র হয় চার-পাঁচ বছরে। এর কতটা খাদ্যাভাবে? তিন-চার বছরের শিশু কতটুকুই বা খায়? আফ্রিকার অতি-দরিদ্র দেশগুলিতেও শিশুরা ভারতের চেয়ে পুষ্ট। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, শৌচাগার ব্যবহার না করায় বার বার পেটের অসুখ, কৃমির জন্যেই এ দেশে অপুষ্টি এত বেশি। যদি তা-ই হয়, তা হলে বছরে বাড়তি ১১ লক্ষ কুইন্টাল ‌শস্যেও শিশু-অপুষ্টির ছবি বদলাবে না।

আর একটা উদ্বেগ, চাষির কী হবে? এত বিপুল পরিমাণে ভর্তুকির চাল আসায় বাজারে চালের দাম বাড়ছে না। এমন চললে ধানের দাম চাষি কতটা পাবে, তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যাচ্ছে।

এমন সব ভারী ভারী চিন্তা থাকবেই। তবু যা ভাবলে মন ফুরফুরে হয়ে যায় তা হল, দুর্নীতি রোখা অসাধ্য নয়। নারদা-সারদা জর্জরিত এই রাজ্যেও প্রায় রাতারাতি চুরি-প্রতারণা রুখে দেওয়া যায়। তার প্রভাব কিন্তু পড়েছে দলের দাদাদের উপরেও। বেশ কিছু রেশন ডিলার জানালেন, তাঁদের দু’নম্বরি আয় কমে যাওয়ার খবর ছড়াতে এই ভোটের মরসুমে চাঁদার জুলুমও কমেছে। কর্মিসভার জন্য চাল-তেল পাঠানোর দাবি নেই বললেই চলে। এই বা কম কী?

তথ্য সহযোগিতা: দেবব্রত দাস, সামসুদ্দিন বিশ্বাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন