দিবস পালনের আড়ম্বরে আছি, শপথ রক্ষার দায় অতিথির নেই

সমাজের প্রায় সব স্তরেই মুখ্য হয়ে উঠেছে উদ্‌যাপনের উৎসব। লক্ষ্যের বদলে পাখির চোখ হয়ে উঠছে প্রচার। লিখছেন রূপক সান্যালসমাজের প্রায় সব স্তরেই মুখ্য হয়ে উঠেছে উদ্‌যাপনের উৎসব। লক্ষ্যের বদলে পাখির চোখ হয়ে উঠছে প্রচার। লিখছেন রূপক সান্যাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৫:২৮
Share:

দিবসগুলো পালিত হয়, শপথগুলো নয়’— অতিপরিচিত বাক্য। প্রতিটি ‘দিবস’-এর শেষেই বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। মাতৃভাষা দিবস পায় হয়ে গেল। সামনেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই রকম নানা দিবসই আসে-যায়। সবই এখন উৎসব। সবই বিশেষ দিন। নতুন পোশাক, ফুল, সুগন্ধি, সুদৃশ রাংতায় মোড়ানো খণ্ড খণ্ড বাঙালিয়ানা। যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ইংরেজি রাইমে অভ্যস্ত, তারাও বিশেষ দিনে ‘ছোট খোকা বলে অ আ’ আউড়ে নেয়। চারদিকে কেমন একটা সুখী সুখী ভাব।

Advertisement

কিন্তু ভেবে দেখলে ভাষাদিবস কোনও উৎসব নয়। শুধুমাত্র শহিদদের স্মরণ করলেই আর নির্দিষ্ট গান গাইলেই কি আমাদের দায় শেষ হয়ে যায়? কেমন আছে বাংলা ভাষা, কেউ তার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছি কি? এবারও কি নিলাম? বলা হয়ে থাকে, ভাষা বহতা নদীর মতো। কোথাও সে খরস্রোতা, কোথাও শান্ত। কোথাও সে ক্ষীণকটি, আবার কোথাও বা প্রশস্ত। আজ কোন জায়গায় পৌছেছে বাংলার শব্দভাণ্ডার, কার্যক্ষেত্রে কতটা ব্যবহার করছি বাংলা, হারিয়েছিই-বা কতটুকু? অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘আমি বাপু বিজ্ঞানের ছাত্র, সাহিত্যটাহিত্য বুঝি না!’ কিন্তু বিজ্ঞানের বইও তো কোনও একটা ভাষাতেই লেখা হয়েছে, আর সেটাও তো সাহিত্য!

কবি আজকাল অনেকেই। তাই কবিতা নিয়ে আলোচনাও হয় অনেক। যদিও কবিতার নতুন কোন আঙ্গিক সৃষ্টি করা গেল কি না বা বাংলা কবিতাকে নতুন কোনও দিশা দেখানো গেল কি না, সে সব আলোচনা প্রায় নেই। যেখানে যতটুকু শুনি বা পড়ি, তার বেশির ভাগই পুরনো দিনের চর্বিতচর্বণ। প্রবন্ধসাহিত্য, ছোট গল্প, বড় গল্প এবং উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা ক্রমশ কমছে। বাংলায় যে সব সাহিত্য সময়কে অতিক্রম করেছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে আঞ্চলিক ভাষা। বিভিন্ন অঞ্চলে বা বিভিন্ন জেলায় একই বাংলা ভাষার নানা রকম রূপ আছে। একজন বিদগ্ধ লেখকের সেই দিকে তীক্ষ্ণ নজর থাকে। কিন্তপ আজকের দিনে আমার রচিত সাহিত্যে আমার অঞ্চলের ভাষার কতটুকু স্থান হচ্ছে?

Advertisement

কত ‘বড়’ জায়গায় কবিতা পাঠ করার আমন্ত্রণ পেলাম, সাহিত্য আলোচনা করলাম বা আমার কতগুলো বই প্রকাশিত হল, তা নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এতে ব্যক্তির অহঙ্কার বা শ্লাঘা থাকতেই পারে, কিন্তু তাতে ভাষার কিছু আসে-যায় না। অনেকে আবার বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিকদের আর তাঁদের কিছু রচনার নাম মুখস্ত করে রাখেন। যেখানেই আলোচনায় বসেন, ওই নামগুলোই আওড়াতে থাকেন। আমরাও ভেবে নিই— ইশ! কত জ্ঞানী! হয়তো জ্ঞানীই, কিন্তু আমার ভাষা কি পেল তাঁদের কাছ থেকে?

তবুও মনে হয়, হয়তো এখনও কেউ কেউ আছেন, যিনি সামাজিক মাধ্যমে লেখেন না, পত্রপত্রিকাতেও লেখেন না, প্রচার নেই, কিন্তু নিবিষ্ট মনে চর্চা করে চলেছেন ভাষার বা সাহিত্যের। হয়তো কোনও একদিন প্রকাশ পাবে তাঁর সৃষ্টি। সেদিন জানতে পারব যে, তিনি এতদিন পালিয়ে ছিলেন না, বরং নিজের মতো করে তৈরি করছিলেন নিজেকে। এই তৈরি হওয়ার কাজটাই আজ আর নেই। আজ আমরা গাছের ডালেই জন্মগ্রহণ করতে চাই, যাতে কষ্ট করে আর গাছে চড়া শিখতে না হয়!

ক’দিন বাদেই ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছরের মতো এ বারও নিশ্চয়ই পালিত হবে সেই দিন। পালন করাটাই এখন মুখ্য। গান, আবৃত্তি, আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা সবই হবে। সঙ্গে থাকবে প্রচার। খোঁজ নেওয়া হবে, ছবি বার হল কি না, টিভি-পরদায় দেখা গেল কি না ইত্যাদি।

মনে পড়ে এক নারীর কথা, যিনি চাদরে বেঁধে আমায় পিঠে ঝুলিয়ে সারা বাড়ির কাজ সারতেন। তিনি আমার মা নন, আত্মীয়ও নন, কেউ নন। তিনি এই উত্তরবঙ্গেই একটি জনপদের একজন খেটে খাওয়া সাধারণ নারী। কিন্তু তিনিই আমার কাছে অনেক কিছু। অনেকেই মনে রাখেননি তাঁকে, লেখেননি তাঁর কথা। আমিও লিখিনি কোনও দিন। তাঁর পরিবার, ছেলেমেয়েরা কে কোথায় ছড়িয়ে আছেন বা আদৌ আছেন কি না, তারও কোনও খবর জানা নেই। স্বামী পরিত্যক্তা সেই নারী লোকের বাড়িতে কাজ করে তাঁর একমাত্র ছেলেকে বড় করে তুলেছিলেন। তার পর একদিন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেই ছেলেই তাঁর মাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল! লেখা হয়নি সে কথাও। এমন অগণিত উদাহরণ আছে, বলে শেষ করা যাবে না।

এখানেই প্রশ্ন জাগে, ভাষাদিবস কাদের জন্য? কাদের জন্য নারীদিবস? কী এর লক্ষ্য? শুধু একটা দিবস পালন? আর সেই দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ না দিলেই এই বসে দেগে দেওয়া যাবে যে, সে ভাষাবিরোধী বা নারীবিদ্বেষী? কারণ, এখন এটাই দস্তুর! আপনি যে যে কী প্রবল আন্তরিক, তা ঢাকঢোল পিটিয়েই প্রমাণ দিতে হবে! সমর্থন বা অনুভূতি মনে মনে রাখলে মোটেই চলবে না!

কোথাও কোনও অনুষ্ঠান হলে কয়েকজন তার আয়োজন করেন। আর বাকি যাঁরা উপস্থিত থাকেন, তাঁরা সবাই অতিথি। অতিথিরা সুসজ্জিত থাকেন। তাঁদের উপর অনুষ্ঠানের দায় বর্তায় না। তাঁরা আসেন, বসেন, আসর ভরান এবং অনুষ্ঠানের শেষে হাততালি দিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ব্যস, এইটুকুই তাঁদের দায়িত্ব। আমরাও এই অতিথির ভূমিকাই পালন করছি বলে মনে হয়। সব কিছুতেই আছি, কিন্তু কোনও কিছুতেই নেই! কোথাও কোনও দায় নেওয়ার দায় নেই!

আমরা যেন অগাধ সমুদ্রে জাল ফেলেছি। কিন্তু যতবারই জাল তুলছি, কিছুই উঠছে না! কারণ, জালের ফাঁকগুলো এত বড় যে, ওই ফাঁক দিয়ে সবই গলে পড়ে যাচ্ছে! তবু জাল ফেলেই চলেছি’ কারণ, জাল ফেলাটাই উৎসব! ওটাই আনন্দ! একই সঙ্গে কার জাল কত বেশি দামি, তা নিয়ে অহঙ্কারও করে চলেছি!

(লেখক কোচবিহারে সরকারি কর্মী। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement