India

প্রশ্নগুলি সহজ নহে

রাজ্য সরকার নামক বস্তুটির প্রয়োজন কি তবে ফুরাইতেছে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২০ ০০:০২
Share:

করোনার অবকাশে দ্রুত অনেক ‘বৈপ্লবিক’ সিদ্ধান্ত লইতেছে কেন্দ্রীয় সরকার। একচল্লিশটি কয়লাখনি নিলাম, শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন বাজারে বিক্রয়, পরিবেশরক্ষার বিতর্কে না ঢুকিয়া একশত একানব্বইটি ভারী শিল্প স্থাপনে সিলমোহরের সহিত সম্প্রতি যুক্ত হইল বিদ্যুতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল— যাহার অভিঘাত যথার্থই সুদূরপ্রসারী। রাজ্য ও কেন্দ্রের যুগ্ম তালিকাভুক্ত একটি বিষয়কে এই বিলে সম্পূর্ণ রূপে কেন্দ্রের অধীন করা হইল। প্রস্তাব আসিল, একটি কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থা গঠিত হইবে, যাহারা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় বিবাদের নিষ্পত্তি করিবে। বিদ্যুতের দাম নির্ণয়, ভর্তুকির সিদ্ধান্ত, সকল কিছুই কেন্দ্রীয় স্তরে নির্ধারিত হইবে, প্রয়োজনে রাজ্য সরকার ভর্তুকি সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাইতে পারে। বিদ্যুৎ বণ্টন সেই ভাবেই হইবে যাহাতে বেসরকারি সংস্থাগুলি এই ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়। দেশব্যাপী বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার হাল যেমন দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে সংস্কার অবশ্যপ্রয়োজনীয় ছিল। তবে তাহার জন্য ইহাই সেরা পথ কি না, সেই প্রশ্ন উঠিতেছেই। রাজ্য সরকার গ্রাহককে সরাসরি ভর্তুকি পৌঁছাইবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হইতে সময় লাগিবে— কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু আজও সারের ভর্তুকি সরাসরি কৃষককে দিতে পারে নাই। ইহাও অনস্বীকার্য যে, বিদ্যুৎ বণ্টন দীর্ঘ দিন ধরিয়াই রাজনীতির ক্রীড়নক, তাহার পরিণামে রাজ্যের বণ্টন সংস্থাগুলিতে বকেয়ার পাহাড় জমিয়াছে। নির্বাচনের পূর্বে বিদ্যুতে ছাড় ঘোষণা করিয়া বৈতরণী পারের প্রয়াসও অতিপরিচিত। কিন্তু সেই রাজনীতির সুযোগ রাজ্য ছাড়িয়া দিল্লির অলিন্দে পা রাখিলেই কি পরিস্থিতি পাল্টাইবে? নিয়ামক সংস্থার হাতে রাজ্যের বিদ্যুৎবণ্টন বিষয়ক ক্ষমতা ন্যস্ত হইলেই যে রাজনীতির প্রভাব অন্তর্হিত হইবে, তাহার নিশ্চয়তাই বা এই দেশে কতখানি? রাজনীতির বাহু কত দীর্ঘ হইতে পারে, নাগরিক তাহা জানেন।

Advertisement

এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভাবা দরকার, বিদ্যুৎ সরবরাহের চরিত্রটি কেমন? বিদ্যুৎ যদি টেলিকমের ন্যায় পরিষেবা হইত, চয়নের সুযোগ থাকিত, তাহা বাজার অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইলে কিছু বলার থাকিত না। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাটি কার্যত সর্বত্রই একচেটিয়া কারবার, বস্তুত তাহা ‘ন্যাচারাল মনোপলি’র দৃষ্টান্ত হিসাবে পরিচিত। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ক্রেতাস্বার্থের সুরক্ষায় বাজারের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থাকেই। বিশেষত, এই পরিষেবাটি ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে জীবনধারণের অত্যাবশ্যক অঙ্গ, এমনকি কৃষিক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ ছাড়া এক পা চলে না। দেশের অর্ধেক মানুষ যেখানে জীবনধারণের সংগ্রাম করিতেছে, করোনার আঘাতে তাহা প্রতি দিন আরও দুর্বিষহ হইতেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎব্যবস্থায় এখন এই সংস্কারের আয়োজন সমাজের নূতন সমস্যা ডাকিয়া আনিবে কি না, তাহা যথেষ্ট বিবেচনা করা হইয়াছে কি? সত্য বলিতে কি, এই ধরনের মৌলিক ও কাঠামোগত সংস্কার যে গভীর বিবেচনা দাবি করে, এখন কি তাহা আদৌ সম্ভব?

আরও একটি প্রশ্ন। রাজ্য সরকার নামক বস্তুটির প্রয়োজন কি তবে ফুরাইতেছে? সংবিধানে যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবধারায় স্নাত, বাস্তবে সেই দেশে রাজ্যের আয় আজ সম্পূর্ণত দিল্লির মুষ্টিতে, তাহার প্রাপ্য পাইতে তীর্থের কাকের ন্যায় অপেক্ষায় থাকিতে হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার রাজ্যের নাই, বিদ্যুৎও চলিয়া গেল। ভিক্ষাপাত্র লইয়া নতজানু রাজ্যের হাতে রহিল শুধু দায়। বিদ্যুৎ যেহেতু রাজ্য তালিকার বিষয় বলিয়াই জানা ছিল, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রের এই সর্বত্রসঞ্চার লইয়া রাজ্য সরকার আপত্তি করিলে সেই আপত্তিকে অযৌক্তিক বলা চলে না। সংবিধানের কাঠামোর ধারাবাহিক বিকৃতি কোনও রাজ্য সরকারের জন্য— বিশেষত কোনও বিরোধী দল-শাসিত রাজ্য সরকারের জন্য—প্রশাসনিক পরিসরকে ক্রমেই সঙ্কুচিত করিতেছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন