রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়ে ওঠে, শিশুরা তবে কার কাছে যাবে

রাতের চেয়েও অন্ধকার

সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের জন্য একটা সাবধানবাণী প্রচলিত আছে: ‘রেসপেক্ট অল সাসপেক্ট অল’। এটা বোধহয় আমাদের সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

Advertisement

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৩২
Share:

আতঙ্ক: শিশুছাত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগে অভিভাবকদের বিক্ষোভ। কলকাতা, ১ ডিসেম্বর ২০১৭। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ক লকাতার একটি অভিজাত পাড়ার বেশ কয়েকটি পরিবারের শিশু একটা ছোট পুলকারে স্কুলে আসাযাওয়া করত। গাড়ির মধ্যবয়স্ক ড্রাইভারটি সুযোগ পেলেই বাচ্চাগুলির শরীরের নানা গোপন জায়গায় হাত দিতে থাকে এবং বিনিময়ে চকলেট দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করে। একটি শিশু নিজের বাবা-মাকে সে কথা জানালে তাঁরা ব্যাপারটা বাদবাকি অভিভাবকদের গোচরে আনেন। সেই অভিভাবকরা কিন্তু ব্যাপারটাকে মোটেও গুরুত্ব দেননি। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বাচ্চারা ও-রকম অনেক কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলে। তা ছাড়া এই ড্রাইভার রোজ সময়মত আসে, কামাই করে না। ওকে ছাড়ালে নতুন গাড়ি ও ড্রাইভার খুঁজে বার করার প্রচুর হ্যাপা। অতএব সেই ড্রাইভারই শিশুদের আনা-নেওয়ার কাজে বহাল থাকে এবং ধরেই নেওয়া যায়, তার অপকর্ম চলতে থাকে সমান তালে। কেউ এক বারও সেই শিশুগুলির মানসিক পরিস্থিতির কথা ভাবলেনও না, যারা নিয়মিত সেই গাড়িচালকের বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছে।

Advertisement

গল্পটি যিনি শোনাচ্ছিলেন, সেই বিশেষজ্ঞ মহিলা দিল্লির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে যৌন-নিগ্রহের শিকার নারী এবং শিশুদের কাউন্সেলিং করেন। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এবং ‘মেল বক্স’-এ এ রকম বহু গল্প জমা হয়েছে। শিশুদের যৌন-নিগ্রহের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও সচেতনতা যে কতটা কম, সেই গল্পগুলো তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

২০১২ সালে কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের করা একটি সমীক্ষা দেখিয়েছিল, ভারতে গড়ে প্রতি দুটি শিশুর এক জন (৫৩ শতাংশ) কোনও না কোনও ভাবে যৌন-নিগ্রহের শিকার হয়। এদের মধ্যে ২০ শতাংশের নিগ্রহ ধর্ষণ বা তার সমতুল্য। এই সমীক্ষা থেকে আরও ভয়ংকর যে তথ্য উঠে আসে তা হল, নিগৃহীত শিশুদের মধ্যে ছেলেমেয়ের অনুপাতটা প্রায় সমান।

Advertisement

শুধুমাত্র বস্তি রেলস্টেশন ইটভাটা বা ফুটপাতের শিশুরাই নয়, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ধনী, মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র, যে কোনও পরিবারের শিশুই, শুধু মেয়ে নয়, ছেলেরাও সেই নিগ্রহের সম্ভাবনার বৃত্তের মধ্যে আছে, থাকে। যৌন-নিগ্রহ মানে তো শুধু ধর্ষণ নয়, তার অনেক রূপ অনেক প্রকার। এবং যৌন-নিগ্রহকারীর চেহারাও সব সময় বলিউডি ‘নোংরা ভিলেনের’ মতো হয় না। তারাও দেখতে শুনতে অনেক সময়েই আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষ। কখনও কখনও তারা রীতিমত শিক্ষিত মার্জিত সু-সংস্কৃত রুচিমান পরিবারের সদস্য বা সদস্যাও। ‘‘একাধিক আলোচনা সভা বা সেমিনারে দেখেছি, শিশু-নিগ্রহকারীদের ‘ওরা’ সম্বোধন করে তাদের মুণ্ডপাত করা হয়। অথচ মজার ব্যাপার হল, এ ব্যাপারে আমরা-ওরা বিভেদ করে কোনও লাভ নেই। ‘ওরা’ তো আমাদের মধ্যে, আমাদের বেশেই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত আমরাই ওরা।’’ আক্ষেপের স্বরে বলছিলেন দিল্লির ওই বিশেষজ্ঞ।

বস্তুত শিশু যৌন-নিগ্রহের ছবিটা আজ কিন্তু আর একটি-দুটি বিকৃতিকামী মানুষের অশ্লীল আচরণে সীমাবদ্ধ নেই, তা এক বৃহত্তর সামাজিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের সমাজে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করে। আমাদের সমাজে আপাত-সুস্থিতি, আমাদের নিরাপত্তা-বোধের বালির বাঁধ ভেঙে পড়তে পারে, আমাদের গোষ্ঠীগত ঐতিহ্য, পারিবারিক সম্মান, বংশগৌরব ইত্যাদি ধুলায় লুণ্ঠিত হতে পারে— সেই ভয়ই কি এই অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যের কারণ?

হয়তো তা-ই। কারণ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যৌন-লাঞ্ছনার শিকার শিশুদের একটা বিরাট অংশের নিগ্রহকারীরা রীতিমত তাদের আপনজন। স্কুল-শিক্ষক, গৃহশিক্ষক, পরিচারক, পিতৃ-মাতৃবন্ধু থেকে শুরু করে নিকটাত্মীয় বা আত্মীয়া, কেউই তালিকার বাইরে নেই। রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়ে ওঠে, তা হলে ওই অবোলা শিশুগুলি প্রতিকার চাইতে যাবে কার কাছে? আর গিয়েও কোনও লাভ হবে কি? শিশুদের আমরা যতটা অবোধ ভাবতে অভ্যস্থ, তারা তো আদৌ তা নয়। তারা জানে কখন ভয় পেতে হয়, কখন চুপ থাকতে হয়, কখন মুখে মুখে তর্ক করলে হিতে-বিপরীত হতে পারে। ‘মনসুন ওয়েডিং’, ‘হাইওয়ে’ থেকে শুরু করে একেবারে হালের ‘কহানি-টু’ ইত্যাদি একাধিক ছবি সমাজের এই ভয়ংকর দিকটার প্রতি আমাদের নজর ফেরানোর চেষ্টা করেছে। আমরা তবু উদাসীনই থেকে গিয়েছি। জল মাথার ওপরে উঠে না এলে আমাদের টনক নড়ে না।

উদাসীনতা রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্তরেও। নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের সেই সমীক্ষা ও তার ফলাফল নীতি-নির্ধারকদের শিশু-সুরক্ষা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল। তারই ফলস্বরূপ ওই বছরই প্রণীত হয় ‘প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট’ (সংক্ষেপে ‘পকসো’)। আমাদের দেশে ধর্ষণসহ যাবতীয় যৌন নিগ্রহের তদন্ত এবং বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন নিগৃহীতের প্রতি যে অসম্মানজনক আচরণগুলি করা হয়, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় তার নাম ‘সেকেন্ডারি ভিক্টিমাইজেশন’। কোনও শিশু যাতে সেই দ্বিতীয় পর্যায়ের লাঞ্ছনা বা মানসিক অবমাননার শিকার না হতে হয়, ‘পকসো’ প্রণয়নের সময় সে দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল, যুগান্তকারী এই আইনটির যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থাদি করা তো দূরস্থান, আইনটির ব্যাপারে জনসাধারণকে সচেতন করার বিশেষ কোনও উদ্যোগও এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। শিশুর যৌন-নিগ্রহ আগাম প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানের বিষয়টি তাই প্রশাসনিক স্তরে এখনও খাতায়-কলমেই থেকে গেছে।

সম্ভাব্য যৌন হেনস্তা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে শহরের দিকে কিছু বেসরকারি স্কুলের শিশুদের ইদানীং ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ বা ‘স্ক্রিম হোয়েন ইউ ফিল অ্যাসল্টেড’ ইত্যাদির শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে দায় নেওয়ার থেকে তা ঝেড়ে ফেলার মানসিকতাই যেন বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। ভাবখানা এই যে, সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হল, এ বার বাচ্চারা নিজেরাই সচেতন হয়ে উঠবে, নিজেরাই নিজেদের লাঞ্ছনার প্রতিকার করবে।

সচেতনতার দায় শিশুদের থেকে আমাদেরই অনেক বেশি। আমাদেরই বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ওই জাতীয় নিগ্রহ নানা রূপে, নানা বেশে আসতে পারে। আসেও। শিশুদের পক্ষে তাদের সবগুলিকে চিনে ওঠা সম্ভব হয় না। অথবা যখন তারা সেটা চিনে উঠতে পারে, ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই যায়। যৌন-নিগ্রহের শিকার হলে একটি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার আত্মবিশ্বাসে কতখানি ফাটল ধরে এবং তার ভবিষ্যৎ জীবনের ভারসাম্য কতখানি বিঘ্নিত হয়, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সে ক্ষতি অপরিমেয়, অপূরণীয়। নিগ্রহের শিকার এমন অনেক অনেক শিশু বিভিন্ন মনোবিদের চিকিৎসাধীন রয়েছে, টানা পাঁচ বছরের কাউন্সেলিং-এও যাদের সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা যায়নি।

জি ডি বিড়লা স্কুলের শিশু-নিগ্রহের ঘটনাটির মতো কোনও কোনও ঘটনা চোখের সামনে চলে আসে মাঝে মাঝে। আমরা তখন প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠি। কিন্তু সেই কাহিনিগুলোর কী হবে, যেগুলোর কথা আমরা জানতেই পারি না বা পারব না? আমাদের ঘরে থাকা ছোটদের দিকেও তাই সতর্ক নজর ফেরানো দরকার, তাদের কথাও একটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে নিজের শিশুটির সঙ্গে একটু সময় কাটাতেই হবে, খেলাচ্ছলে জেনে নিতে হবে তার নানা সুবিধা-অসুবিধার কথা, সমস্যার কথা। নজর রাখতে হবে তার প্রতিটা আচরণের দিকে। সে কখনও লুকিয়ে কাঁদে না তো? পরিচিত বা অল্পপরিচিত কোনও মানুষকে সে অকারণ ভয় পাচ্ছে না তো? এমনকী পুতুল খেলার সময় যদি সে পুতুলের দেহের কাল্পনিক যৌনাঙ্গগুলি নিয়েও বেশি নাড়াচাড়া করে, সেই সম্ভাব্য সংকেতকেও চিনে নিতে হবে।

সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের জন্য একটা সাবধানবাণী প্রচলিত আছে: ‘রেসপেক্ট অল সাসপেক্ট অল’। এটা বোধহয় আমাদের সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অতিরিক্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ার কোনও দরকার নেই। কিন্তু সাবধানের মার নেই। এবং দিনকাল ভাল নয় একেবারেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন