‘অবর’ মানে উভয়সংকট

যাঁরা চিনের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে ভারতের নাম উচ্চারণ করার কু-অভ্যাস ছাড়তে পারেননি, অবর তাঁদের খোয়াবনামার শেষ পাতাটাও উল্টে দিল। অবশ্য, এত দিন অপেক্ষা করার দরকার ছিল না।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৭ ১৩:৪১
Share:

নায়ক: অবর সম্মেলনে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং ও অন্য রাষ্ট্রনেতারা। ছবি: গেটি ইমেজেস

খরচ চার লক্ষ কোটি ডলার। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার প্রায় সত্তরটা দেশকে বেঁধে ফেলা সড়ক আর সমুদ্রপথে। রাশিয়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে ভূমধ্যসাগর, মঙ্গোলিয়া থেকে সিঙ্গাপুর— ছ’টা করিডর আর সমুদ্রপথের সিল্ক রুটে কার্যত অর্ধেক দুনিয়াকে নিজেদের দেশের সঙ্গে জুড়ে নেওয়া। সংক্ষেপে, এটাই চিনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ বা ‘অবর’ প্রকল্প। আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাস এহেন পরিকল্পনা দেখেনি। মহাপরাক্রমী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গত শতাব্দীতে তার পরম প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেবে উঠতে পারেনি এহেন দুনিয়াজোড়া বাণিজ্যপথ তৈরির কথা। চিন ভেবেছে। এবং, সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে নেমে পড়েছে।

Advertisement

যাঁরা চিনের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে ভারতের নাম উচ্চারণ করার কু-অভ্যাস ছাড়তে পারেননি, অবর তাঁদের খোয়াবনামার শেষ পাতাটাও উল্টে দিল। অবশ্য, এত দিন অপেক্ষা করার দরকার ছিল না। পাকিস্তান থেকে ভেনেজুয়েলা, শ্রীলঙ্কা থেকে কাজাকস্তান, কার্যত গোটা আফ্রিকা— দুনিয়ার প্রায় অর্ধেকটাই চিনের ঋণের জোরে চলছে। আইএমএফও যেখানে ঋণ দিতে নারাজ হয়, চিন সেখানেও উদারহস্ত। তার ওপর আছে চিনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা। নাইরোবি থেকে মোজাম্বিক অবধি রেললাইন, জাম্বিয়ার তামার খনি, শ্রীলঙ্কার এয়ারপোর্ট, নেপালের রাস্তা, দুনিয়া জুড়ে চিনের ব্যবসায়িক স্বার্থ আর আর্থিক সাহায্যের অবিচ্ছেদ্য নেটওয়ার্ক। একশোটারও বেশি দেশের বৃহত্তম বাণিজ্যসঙ্গী চিন। দুনিয়ার মোট রফতানির ১৪ শতাংশই সে দেশ থেকে আসে। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার প্রেক্ষিতে একুশ শতকের বৃহত্তম অর্থনৈতিক বিশ্বশক্তি হিসেবে চিন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। অবর-এর অবিশ্বাস্য ঔদ্ধত্য হল সেই প্রতিষ্ঠার ওপর শেষ সিলমোহর।

যে দেশগুলোর ওপর দিয়ে অবর-এর রাস্তা যাবে, অথবা যে দেশের বন্দর ছোঁবে অবর-এর জলপথ, শুধু তারাই নয়, এই মানচিত্রের বাইরে থাকা অনেক দেশও প্রকল্পটিতে যোগ দেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে। ব্যতিক্রম ভারত (এবং ভুটান)। মাসখানেক আগে বেজিং-এ বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরাম-এর বৈঠকে যোগ দিতে ভারত সপাট অস্বীকার করল। ভারতের আপত্তির ঘোষিত কারণ, চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের একটা দীর্ঘ অংশ যাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে। অত্যন্ত সংগত কারণেই ভারত বলেছে, ভারতের অমতে যদি সেখানে এই রাস্তা তৈরি হয়, তবে তা ভারতের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ। তবে, যতটুকু ঘোষিত হয়, তার পরেও থেকে যায় আরও অনেক কথা। চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত-বিরোধ, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চিনের অবস্থান— সবই অবর-বিরোধিতার কারণ। আরও বড় কারণ, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির মহানায়কের কাছে চিনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আসলে ঘরোয়া রাজনীতির হাতিয়ার। চিনকে কড়া ভাষায় চমকে দিতে পারা মানেই পরের জনসভায় হাততালির ঝড়। হয়তো ভোটও। ফলে, যে অবর চিনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞান, তার থেকে নিজেদের দূরে রাখা ছাড়া নরেন্দ্র মোদীর সম্ভবত খুব বেশি কিছু করারও ছিল না।

Advertisement

অবর এমনই এক প্রকল্প, যার সঙ্গে ভারতের জড়ানো মুশকিল, আবার না জড়িয়েও উপায় নেই। তাকে মেনে নেওয়া মানে পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ন্ত্রণরেখাকেই প্রকৃত সীমান্তের স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু দূরে থাকাও ভারতের পক্ষে মুশকিল। প্রকল্পটা দুনিয়াজোড়া, কিন্তু মনে রাখা ভাল, চরিত্রে সেটা বহুজাতিক নয়। সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি দেশের সঙ্গে চিনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হচ্ছে। অবর-এর বিপুল পরিকাঠামোর খরচ জোগাতে চিন উদারহস্তে ঋণ দেবে। কিন্তু, নিঃশর্তে নয়। চিনের প্রযুক্তি, চিনের সংস্থা, চিনের শ্রমিক নিতে হবে তো বটেই, বেশ চড়া হারে সুদও দিতে হবে। সুদ না দিতে পারলে চিনকে ইক্যুইটি দিতে হবে। অর্থাৎ, অবর-এর মাধ্যমে চিন বহু দেশের বহু পরিকাঠামোর মালিক হয়ে বসতে পারে, সে সম্ভাবনা প্রবল। পরিকাঠামোর দখল মানেই চিনের সামরিক শক্তির জন্যও দখলদারি। আফ্রিকায় জিবুতি আর পাকিস্তানের গ্বাদর বন্দর ঠিক এই ভাবেই চিনের নৌসেনার নাগালে এসেছে।

ঋণ শোধ করতে না পারার সম্ভাবনাও প্রবল। বেজিং-এ বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামের বৈঠকের ঠিক আগেই রাষ্ট্রপুঞ্জ একটা সতর্কবার্তা প্রকাশ করে। তাতে দেখা যাচ্ছে, অবর-এর জন্য চিন উজবেকিস্তানকে যে ঋণ দিচ্ছে, তা সে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সিকি ভাগের সমান। কাজাকস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনুপাতটি ২০ শতাংশের কাছাকাছি। নেপাল, শ্রীলঙ্কারও অবস্থা একই রকম। দেশগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যের যা হাল, তাতে এই ঋণ শোধ করা দুঃসাধ্য। তার অবশ্যম্ভাবী ফল, অদূর ভবিষ্যতে এই দেশগুলোতে চিনের সামরিক উপস্থিতি অনেকখানি বাড়বে। পুবে ভিয়েতনাম, মায়ানমার থেকে পশ্চিমে পাকিস্তান-আফগানিস্তান, ভারতকে চার পাশ দিয়ে ঘিরে ফেলবে চিনের সামরিক উপস্থিতি, এটাকে আর নেহাত কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। অবর-এ যোগ দিতে রাজি হোক বা না-ই হোক, চিনের সামরিক আধিপত্য ভারতের কাছে আপাতত অনস্বীকার্য।

ভারতকে মোক্ষম ডুবিয়েছে আমেরিকা আর জাপান। শেষ মুহূর্ত অবধি বিদেশ মন্ত্রকের ভরসা ছিল, আর যা-ই হোক, এই দুটো দেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামে যোগ দেবে না। দেখা গেল, জল মাপতে ভুল হয়েছিল বিলকুল। জাপানের সঙ্গে চিনের ভূ-রাজনৈতিক বিরোধ মিটে যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চিনের সামরিক প্রসারণ মেনে নিতে মনস্থ করেনি মোটেও। কিন্তু, অর্থনীতির বাড়া তাগিদ নেই। অবর বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ব্যাপক প্রকল্প হতে চলেছে। এবং এই প্রকল্প বাবদ চিন যে ঋণ দেবে, তার শর্তই হল চিনের থেকে রাস্তা তৈরির জিনিসপত্র কেনা। বস্তুত, গত কয়েক বছরে চিনে যে পরিমাণ ইস্পাত আর সিমেন্ট উৎপন্ন হয়েও বিক্রি হয়নি, সেটা এই প্রকল্পে খাইয়ে দেওয়া হবে। আমেরিকা হোক বা জাপান, সব দেশই এই লাভের গুড়ের ভাগ চায়। প্রকল্পের সব কাজ যাতে চিনের সংস্থার জন্যই ধরা না থাকে, তা নিশ্চিত করা এখন কূটনীতিকদের মস্ত কাজ। ফলে, এ মুহূর্তে চিনকে চটাতে কারও আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক।

এখানেই ভারতের বিপত্তি। অবর-এ যোগ না দিলে এই প্রকল্প নিয়ে দরকষাকষির কোনও পথ দিল্লির সামনে খোলা থাকে না। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে চিনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির চরিত্র কী হবে, সেটা দিল্লির নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে যায়। আবার, যোগ দিলে সীমান্ত প্রশ্নে হার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে ঘরোয়া রাজনীতির প্রশ্ন বানিয়ে ফেললে কী বিপদ হয়, সেটা বোঝা গেল নিশ্চয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন