প্রতীকী ছবি।
কথার জড়তা কাটাইবার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ লইতে গিয়া গুরুতর আহত এক শিশু— মারধরের অভিযোগ উঠিয়াছে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। নেশাসক্তি ছাড়াইবার আবাসিক কেন্দ্রে ধর্ষিত এক কিশোরী— কেন্দ্রের অধিকর্তা অভিযুক্ত, ধৃত। মানসিক হাসপাতালে প্রতীক্ষারত এক রোগীকে বাঁশ দিয়া আঘাত করিল এক পুলিশকর্মী— কেন, লালবাজার উত্তর দেয় নাই। কয়েক দিনের ব্যবধানে মর্মান্তিক তিনটি সংবাদ প্রকাশ পাইল। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের প্রতি আজও দেশ সংবেদনশীল হইতে পারে নাই, এমনকী মানবিকতার প্রথম পাঠও অনুশীলন করে নাই। তথাকথিত নেশামুক্তি কেন্দ্রে প্রহারের ফলে আবাসিকের মৃত্যুও ঘটিয়াছে। ২০১২ সালে হুগলির গুড়াপে বেসরকারি আবাসে একাধিক মনোরোগী মহিলার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাও রাজ্যবাসী ভোলে নাই। মনোরোগীদের নির্যাতন ও অপমৃত্যুর সংবাদ নানা রাজ্য হইতেই নিয়মিত আসিয়া থাকে। যে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতার প্রতি ভারতের সমাজ উদাসীন, প্রায়শ অসহিষ্ণু। পরিবার হইতে প্রশাসন, সকলেই যে কোনও উপায়ে তাহাদের দৃষ্টির বাহিরে করিতে পারিলেই বাঁচে। চিকিৎসার ব্যবস্থা দূরস্থান, সুস্থ জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনও নিশ্চিত করা হয় না।
প্রতিবন্ধী ও মনোরোগীদের সম্মান ও সমাদর করিবার অভ্যাসটিই যেন এই সমাজে তৈরি হয় নাই। অকারণ নির্যাতন, বন্দিত্ব এবং অবহেলাই যেন তাহাদের ন্যায্য প্রাপ্য। অথচ মানসিক রোগীদের সুরক্ষার জন্য নূতন আইন হইয়াছে, তাহা শীঘ্রই কার্যকর হইবে। তাহাতে মনোরোগী ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকার ও স্বাধিকার পূর্বের তুলনায় অধিক গুরুত্ব পাইয়াছে। আশ্বাসের কথা। কিন্তু আইন থাকিলেও কি মানা হইবে? আইন অনুসারে নেশামুক্তি কেন্দ্রগুলিতে এক জন চিকিৎসক এবং এক জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থাকিবার কথা। তাঁহাদের না রাখিয়াও বহু কেন্দ্র চলিতেছে। আবাসিকদের সুরক্ষা বা চিকিৎসার উপর নজরদারির কোনও ব্যবস্থা কাজ করিতেছে, তাহার ইঙ্গিত মেলে নাই। নেশামুক্তি কেন্দ্র বা মনোরোগীদের অসরকারি আবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কারা, তাহাদের যোগ্যতা কী, যাচাই করা হয় না। প্রশাসনিক ঔদাসীন্য এবং পরিবারের নাজেহাল পরিস্থিতি, দুইয়ের সুযোগ লইয়া নানা অসাধু ব্যবসায়ী আবাসিক কেন্দ্র খুলিয়া একাধারে শোষণ ও নির্যাতন চালাইতেছে। পরিদর্শনে স্বচ্ছতা ও তৎপরতা না আনিলে উপায় নাই।
সেই সঙ্গে জনজীবন হইতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের বিচ্ছিন্নতা দূর করিতে হইবে। শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধ অপেক্ষাও বৃহত্তর জনসমাজের প্রত্যাখ্যান তাঁহাদের অধিক বিপন্ন করিয়া তোলে। কর্মক্ষেত্র, পরিহবহণ, বিনোদন, সকল ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের স্থান করিতে আজও এই শহর, এই রাজ্য ব্যর্থ হইয়াছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ইহাদের অন্তর্ভুক্তিও সে ভাবে হয় নাই। রাজ্যের সেরা স্কুলগুলিতেও বিশেষ শিশুদের উপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা নাই। আবার বিশেষ প্রশিক্ষণ ও সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠান অতিশয় কম। এখন সেখানেও নির্যাতনের অভিযোগ উঠিতেছে। ইহার প্রতিকারে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ, সব কয়টি দফতরকে সুসংহত উদ্যোগ করিতে হইবে। নাগরিক সমাজেরও সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।