যে ভাবে রেল ‘স্বচ্ছ’ হতে পারে

কিছু দূর যাওয়ার পরে প্রায় সব লোকাল ট্রেনের গোটা মেঝেটাই ‘ডাস্টবিন’ হয়ে যায়। চায়ের কাপ, বাদামের প্যাকেট, ফলের খোসা, বিচিত্র আবর্জনা যাত্রীদের নিত্যসঙ্গী।

Advertisement

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:২৩
Share:

ঝড়বৃষ্টির দাপটে লালগোলা থেকে শিয়ালদহ যাওয়ার ট্রেন সে দিন প্রায় ফাঁকা। যে লোকালে দাঁড়ানোর জায়গা মেলা ভার, তাতে দিব্যি জানলার পাশে জায়গা মিলল। উল্টো দিকের আসনে বসেছিলেন দুই বৃদ্ধ। পরনে লুঙ্গি, মাথায় টুপি। কামরার মেঝের এ দিক, ও দিক তাকিয়ে এক জনের স্বগতোক্তি, ‘কী নোংরা করে রেখেছে রে বাবা!’

Advertisement

কিছু দূর যাওয়ার পরে প্রায় সব লোকাল ট্রেনের গোটা মেঝেটাই ‘ডাস্টবিন’ হয়ে যায়। চায়ের কাপ, বাদামের প্যাকেট, ফলের খোসা, বিচিত্র আবর্জনা যাত্রীদের নিত্যসঙ্গী। উপায় কী? কখনও কখনও বাদাম শেষ করে প্যাকেটটা প্যান্টের পকেটে কিংবা ব্যাগে হয়তো রেখে দিই। কিন্তু শেষ হওয়া চায়ের কাপ বা ভুট্টার কাঠিটা নিয়ে কী করব? সেগুলো স্থান পায় ট্রেনের মেঝেতেই। আবর্জনার স্তূপ আরও একটু বাড়ে।

কিন্তু সে দিন জনবিরল কামরায় যা দেখা গেল, লোকালযাত্রার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আগে তা চোখে পড়েনি। ওই দুই মুসলমান বৃদ্ধের এক জন নিজের প্লাস্টিকের চপ্পলটাকে ঝাঁটার মতো ব্যবহার করে সরাতে শুরু করলেন মেঝের আবর্জনা। নিজেদের আসন তো বটেই, আশপাশের অন্তত গোটা ছয়েক আসনের নীচের মেঝে পরিষ্কার করলেন। আবর্জনা সরিয়ে রাখলেন এক পাশে। তাঁর সঙ্গী নিরুত্তাপ। ভাবখানা এমন, নোংরা থাকলে তো পরিষ্কার করতেই হবে। এটাই তো স্বাভাবিক। কামরার একটা অংশ একেবারে ঝকঝকে করে দিয়ে বৃদ্ধ তৃপ্তির হাসি হাসছেন। যেন তাঁর বাড়ির বৈঠকখানা সাফ করলেন। এর পর দুই বৃদ্ধ অজু করে নিজেদের আসনেই ঈশারের নমাজ শুরু করলেন।

Advertisement

মনে হতেই পারে, ওই দু’জনের নমাজ পড়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের প্রয়োজনেই নোংরা মেঝে সাফসুতরো করলেন। হয়তো তাই। কিন্তু কাজটা দায়সারা ভাবে, বিরক্তির সঙ্গে করলেন না। আর কেবল নিজের যতটুকু জায়গা দরকার, ততটুকুই করলেন, এমন নয়। যে যত্ন, আন্তরিকতার সঙ্গে করলেন, তার দেখা পাওয়া বিরল। মনে হল, তাই তো, চাইলেই আমরা পারি। কিন্তু করি না। দেশকে স্বচ্ছ করতে নানা অভিযানে অনেকে শামিল হই। ক্যামেরার ঝলকানিতে নেতা-কর্মীদের পুলক জাগে। কিন্তু দেশকে যদি সত্যিই স্বচ্ছ করতে হয়, তা হলে নিজের শক্তিতে যেটুকু করা যায়, সেটুকু করলেই তো কাজ হয়! ট্রেনে উঠে শুধু রেল দফতরকে গাল না দিয়ে আশপাশটা সাফ করে ফেললেই হয়।

যে জায়গাটা সবার জন্য, তাকে নোংরা করার মধ্যে এই চিন্তাটাই কাজ করে যে, ‘কার কী অসুবিধে হল, গা গুলিয়ে বমি এল কি না, তাতে আমার কী?’ তাকে পরিষ্কার করার মধ্যে থাকে ঠিক এর উল্টো মনোভাব। ‘অন্যের অসুবিধে হবে? তার চাইতে আমিই সাফ করে দিই।’ সেখানে দফতর, যানবাহন, রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতাও আমারই দায়িত্ব। আমি তার মালিক বলে নয়। তা ব্যবহার করি বলে।

সেই সঙ্গে রেলকেও কিছু প্রস্তাব দেওয়া চলে, যাতে পরিচ্ছন্ন থাকে রেলের কামরা। স্বচ্ছ যাত্রা না হলে শুভ যাত্রা হয় কী করে?

একটা সময় কাগুজে টিকিট চালু ছিল। তখন রেলের শৌচাগার, মেঝেতে সেই টিকিট পড়ে থাকত। কেউ কেউ আবার গুঁজে রাখতেন পাখার গায়ে। এখনও যে থাকে না, তা নয়। তবে ই-টিকিটের সৌজন্যে তা এখন অনেক কমে গিয়েছে। মেট্রোতে স্মার্ট কার্ড ও টোকেন আসার পর মেঝে অনেক পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু উৎসবের সময় মেট্রো কর্তৃপক্ষ কাগজের টিকিটের ব্যবস্থা করেন। সেই সময়ে মেট্রোর হাল দেখলেই টের পাওয়া যায় পরিচ্ছন্নতায় পার্থক্য। লোকাল ট্রেনেও টোকেন, বা পুনর্ব্যবহারের যোগ্য টিকিটের দিকে ঝোঁকা দরকার।

লোকালের প্রতিটি কামরায় তারের ফ্রেমে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখলেই আবর্জনা ফেলার জায়গা তৈরি হয়। প্রতিটি স্টেশনে নিয়মিত দূরত্বে থাকুক আবর্জনা ফেলার জায়গা। টিকিট সংগ্রহের সময়ে যাত্রীদের হাতেও ধরিয়ে দেওয়া যেতে পারে একটি ব্যাগ। যাত্রাপথে সেই ব্যাগেই রাখা থাক বাদামের খোসা, চিপসের প্যাকেট। গন্তব্যে পৌঁছে সেই ব্যাগ ফেলে দেওয়া যেতে পারে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে। বিষয়টিকে আকর্ষণীয়ও করা যেতে পারে। ধরা যাক, আবর্জনা-ভর্তি প্যাকেট ফেরত দিলে, এবং সেই সঙ্গে ট্রেনের টিকিট দেখালে সেই যাত্রীকে কিছু টাকা ফেরত দেওয়া হল। দুর্নীতির আশঙ্কা করলে একটা কুপনও দেওয়া যেতে পারে। পরের যাত্রায় সেই যাত্রী টিকিট কাটতে গিয়ে কুপন দেখালে কিংবা কুপনের নম্বর জানালে টিকিটে কিছুটা ছাড় পাবেন।

দিন-মাস-বছর ধরে হিসেব করে কেউ বলতেই পারেন, এতে তো বিস্তর খরচ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে ৯৩৭০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে স্বচ্ছ ভারত অভিযান খাতে। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে নরেন্দ্র মোদী সরকার আরও ৭৮৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। রেলযাত্রীদের সচেতন করতে না হয় সেখান থেকে সামান্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করা হোক। যাতে সরকারি সম্পত্তিকে মানুষ তাচ্ছিল্য না করেন। কারও বাড়ির সামনে কেউ নোংরা ফেললে চরমে ওঠে বিবাদ। রেগে গিয়ে অনেকে বলেন, ‘এটা কি সরকারি সম্পত্তি নাকি যে, যা খুশি তাই করবে!’ এই মনোভাবটাই বদলানো দরকার। যাতে আমাদের সন্তানেরা বলে, ‘এ হল সরকারি সম্পত্তি, যা খুশি তাই করা যাবে না।’ সে দিন যে কোনও জনস্থান প্রার্থনা করার মতো পবিত্র হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন