অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সমাজের এমন প্রতিবাদ আগে কেন দেখা যায় নাই? এখন সহসা এত শোরগোলের কারণ কী? ভারতীয় জনতা পার্টি ও তাহার বিবিধ শাখাপ্রশাখা হইতে নানা মাপের নায়কনায়িকা ও মুখপাত্রগণ প্রশ্নটি তুলিতেছেন। প্রতিবাদ অব্যাহত, প্রতিপ্রশ্নও। কথাটি উড়াইয়া দিবার নয়। অরুণ জেটলি কথিত ‘সহিষ্ণু ভারত’-এ অসহিষ্ণুতা নূতন নহে। তাহার জঙ্গি রূপও ভারতবাসী বিস্তর দেখিয়াছে। শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃষ্টির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা হইতে শুরু করিয়া আক্রমণ, বিতাড়ন, এমনকী হত্যা অবধি সহিষ্ণু ভারতকে বারংবার কলঙ্কিত করিয়াছে, সংস্কৃতিগর্বিত পশ্চিমবঙ্গ এবং তাহার রাজধানীও ব্যতিক্রম নহে তসলিমা নাসরিনকে এই শহর তাড়াইয়া ছাড়িয়াছে। ইতস্তত প্রতিবাদ তখনও ছিল, কিন্তু এই মহাপ্লাবন সত্যই নূতন। এখনও কেহই ইহার নিশ্চিত কারণ স্থির করিতে পারেন নাই। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা চলিতেছে, পাকা রিপোর্ট আসে নাই।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সহকর্মীরা অতিব্যস্ত। তাঁহারা ঠিক প্রশ্নটি তুলিয়াছেন বটে, কিন্তু রহস্যের সমাধান না করিয়াই আপন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন। রোগনির্ণয়ের আগেই রিপোর্ট প্রস্তুত। অরুণ জেটলি হইতে বেঙ্কাইয়া নাইডু, শাসক গোষ্ঠীর প্রবীণ নেতারা সমস্বরে রায় দিয়া চলিয়াছেন: এই প্রতিবাদীরা নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দলকে সহ্য করিতে পারেন না, তাই অসহিষ্ণুতার ধুয়া তুলিয়া আন্দোলন শুরু করিয়াছেন, ইহা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মিত আন্দোলন, ইহার ফলে এক দিকে দুনিয়ার হাটে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হইতেছে, অন্য দিকে আর্থিক উন্নয়নের জন্য মোদী সরকারের উদ্যোগ ব্যাহত হইতেছে। ইহার পাশাপাশি, বিজেপি এবং তাহার পরিবার হইতে ‘গোমাংস ভক্ষণ দেশদ্রোহের সমান’ বা ‘শাহরুখ খানের পাকিস্তান-প্রীতি’ গোছের যে সব চিত্কার উঠিতেছে, সেগুলিকে উন্মাদের প্রলাপ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলিত, কিন্তু এই উন্মাদদের যথেষ্ট তিরস্কার না করিয়া এবং কঠোর শাস্তি না দিয়া প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার প্রবীণ সহনায়করা সংকেত দিয়াছেন যে, প্রতিবাদীদের ‘শত্রু’ বলিয়া গণ্য করিবার বিষয়ে তাঁহারাও সম্পূর্ণ একমত, কেবল প্রকাশ্যে শত্রুর ‘মুণ্ডচ্ছেদ’ দাবি না করিলেই হইল।
এত প্রতিবাদ কেন, সেই প্রশ্নটি শাসকরা নিজেদের জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ বা শিল্পী তো বটেই, শিল্পোদ্যোগী, অভিনেতা, বিজ্ঞানী, এমনকী বিজ্ঞানীদের একাধিক সংগঠন অবধি প্রতিবাদে শামিল হইয়াছেন। এই ধরনের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুখে এমন প্রতিবাদ বিরলতম বলিলেও কম বলা হয়। তাঁহারা সকলেই মোদীকে দেখিতে পারেন না? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর বা মুডি’জ-এর বিশেষজ্ঞরা কৌশলে বিরোধী রাজনীতি করিতেছেন? উদ্ভট রকমের ছেঁদো কথায় নিজেদের না ভুলাইয়া শাসকরা বরং ভাবিয়া দেখুন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষত শিক্ষা, সংস্কৃতি, সম্প্রচার ইত্যাদি মন্ত্রকের আওতায় থাকা নানা বিষয়ে অত্যধিক আধিপত্যের প্রবণতা কতটা অসন্তোষ সৃষ্টি করিয়াছে; ‘হিন্দুত্ববাদী’ বলিয়া পরিচিত বা স্বঘোষিত নানা সংগঠনের অশালীন হিংস্র আচরণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সামাজিক পরিবেশ কতটা বিষাইয়া দিয়াছে; এই সকল আচরণের স্পষ্ট নিন্দা না করিয়া, দুরাচারীদের কঠোর শাস্তির আয়োজন না করিয়া সরকারি ও দলীয় কর্তারা কার্যত তাহাদের কী পরিমাণ প্রশ্রয় দিয়াছেন। এবং ভাবিয়া দেখুন, খাস বিজেপির নেতাদের উৎকট সমস্ত উক্তি অসহিষ্ণুতার ধারণাটিকে কতখানি জোরদার করিয়াছে। ভাবিলেই যে সব উত্তর পাইবেন, তাহা নহে। কিন্তু উত্তর অভিমুখে হাঁটিতে পারিবেন। বালিতে মুখ গুঁজিয়া প্রলয় বন্ধ করা যায় না। এবং, বালি নহে, উহা অসহিষ্ণুতার পাঁক।