আশ্বিনের শারদপ্রাতে আকাশবাণীতে বেজে উঠত আলোকমঞ্জীর। আধো-ঘুম, আধো-জাগরণে শিঙাড়া, নিমকি, জিলিপি আর চা দিয়ে শুরু হত মহালয়ার পুণ্যপ্রভাত। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শেষ হওয়ার আগেই ব্রেকফাস্ট শেষ করা চাই। সকাল আটটা বাজলেই পৌঁছে যেতে হবে পার্বতী সিনেমায়।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সিঙ্গল-স্ক্রিন সিনেমা হলগুলো সরগরম। উত্তম-সৌমিত্র, সুচিত্রা-সুপ্রিয়া, একের পর এক হাউসফুল শো তো চলেই, তার ওপর পুজো এলেই সকালবেলায় সিনেমা হল হয়ে যেত গানের আসর। এপিদা-র মহালয়ার জলসা হাওড়ায় ছিল বিখ্যাত। পোশাকি নাম ছিল মহাদেব, কিন্তু পাড়ার ‘দাদা’ এপি রায় ছিলেন সবার প্রিয় ‘এপিদা’। তিনি গান গাইতেন না, অনুষ্ঠানের দালালি করতেন না, আর ‘শিল্পীসঙ্গী’ হয়ে কাগজে ছবি ছাপার প্রচলন তো সে যুগে ছিলই না। কেবল প্রাণের তাগিদে, পাড়াপড়শির আবদারে বসাতেন জলসা। তখনকার বিখ্যাত শিল্পীরা কে না আসতেন।
শুরুটা হত দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের রেডিয়ো-ফেরত ‘জাগো, তুমি জাগো’ দিয়ে। তার পর সদ্য-প্রকাশিত পুজোর গান শিল্পীর মুখে ‘লাইভ’ শোনার উত্তেজনা। তখন পুজোর রেকর্ডের বিজ্ঞাপন হত ছড়ায়। যেমন, ‘‘ঢ্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বাজে পুজোর পরব আসে, পূজার গানের সুর যে ছড়ায় সূর্যে নীল আকাশে।’’ অবশ্য শিল্পীরাও খানিক বিজ্ঞাপন করতেন। শ্যামল মিত্রের গলায় ‘কারেন্ট’ গান, ‘কী নামে ডেকে’ গাওয়া শেষে শ্রোতাদের অনুরোধ, রেকর্ডের অন্য পিঠের গান গাইতে হবে। শিল্পীর উত্তর, ‘‘রেকর্ড নম্বর অমুক, কিনে শুনে নেবেন।’’ শ্রোতাদের চুন হয়ে যাওয়া মুখে হাসি ফোটালেন পরের গায়ক, প্যারডি শিল্পী মিন্টু দাশগুপ্ত। সেই শ্যামল-গানকেই ধরে গাইলেন, ‘‘প্রিয় নামে ডেকে বললে আমাকে, লিখলে চিঠি ঘুরলে পিছে বলবে দাদাকে।’’ হাসির লহরে সুরে ফিরল আসর।
আজকের ষাটোর্ধ্ব আমার বয়স তখন বছর বারো। ষষ্ঠীর সকালে দুরুদুরু বুকে বাস বদলে বদলে হাওড়া থেকে হাতিবাগানে, রাধা সিনেমায়। টিকিট কেটে হলে ঢুকে চার পাশ দেখে নিয়ে হাঁপ ছাড়তাম। চেনাজানা কেউ নেই, বাড়িতে রিপোর্ট পৌঁছবে না। পর্দা সরল, আর যেন আমার মনের ভাষায় শুরু করলেন সনৎ সিংহ, ‘‘নন্দীবাড়ির আটচালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে, মন বসে কি আর? আহা হা চণ্ডীতলায় বাদ্যি বাজে ঢ্যাম কুড়াকুড় কুড়ুর কুড়ুর তাক।’’ সেই মুড একেবারে বদলে দিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন ছিপছিপে যুবক। ‘‘পরাণের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা।’’ রবীন্দ্রনাথের ‘ঝুলন’ থেকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’, আশ্চর্য পরিক্রমা। তার পরে তরুণ বাউল প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারীর ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ ছুঁয়ে অনুভা গুপ্তের কণ্ঠে নজরুলের ‘সব্যসাচী’।
সপ্তমীতে ঝর্না সিনেমায় বসত পুজোর জলসা। প্রতি বছর ফিরিয়ে আনত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। রেকর্ড সঙ্গীতের বিজ্ঞাপন বেরোত, ‘‘বছরে দুটি মাস হেমন্তকাল কিন্তু তা আছে পঞ্জিকার পাতায়। বাঙালির অন্তরে হেমন্তের কাল বারো মাস।’’ ঝর্না সিনেমার জলসায় দু’এক জন ‘লোকাল ট্যালেন্ট’-এর পরে একাই টানতেন হেমন্ত। কখনও উনপঞ্চাশের প্রথম শারদ অর্ঘ্য, ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’, কখনও আবার ‘পালকির গান’, ‘রানার’। হেমন্ত গাইছেন, ‘‘শুধু এই পথ চেয়ে থাকা, ভাল কি লাগে’’, কিংবা ‘‘শুনেছ কি মানুষের কান্না বাতাসে বাতাসে বাজে’’, সামনে বসে তা শোনা, এর রোমাঞ্চ কে ভুলতে পারে?
নবমীর প্রভাতে হাসির আসর বসত সালকিয়ার পারিজাত সিনেমায়। সেখানে ভরা হাট হাস্যকৌতুক শিল্পীদের। কে নেই? অজিত চট্টোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যাম লাহা, অমূল্য সান্যাল, হরিধন মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, আর অবশ্যই জহর রায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনও কখনও সঙ্গ দিতেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় আর তরুণকুমার। মিন্টু দাশগুপ্তের প্যারডিতে পর্দা সরত, ‘‘প্রভু শনিবারে কোরো মোরে রাজা, আছে ঘোড়ার খবর কিছু তাজা।’’ আজ সহাস্য কমিক প্রায় বিস্মৃত, কিন্তু তখন পেটে খিল ধরত, আর মনে ফুর্তি ভরে উঠত। এক পুজো থেকে আর এক পুজোর প্রতীক্ষা, ভরে থাকত সুর আর হাসিতে। এমন আনন্দযজ্ঞেই ফিরে ফিরে আসত দুর্গাপুজোর শেষ প্রহর।
ছেলেবেলা আর কৈশোরের পুজোর অঞ্জলি সেজেছে এমনই নানা জলসার শিল্পীর প্রকরণে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে কলকাতা আর হাওড়া থেকে পুজোর জলসার এই জনপ্রিয়তায় ক্রমশ ভাটা পড়তে থাকে। তার কারণ অনেক। মধ্য-আশির পর থেকেই হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র, ধনঞ্জয়, সন্ধ্যার মতো শিল্পীরা বয়স, অসুস্থতা ও অন্যান্য কারণে ক্রমশ সঙ্গীতজগতের মধ্যগগন থেকে সরে গেলেন। তাঁদের জায়গায় তাঁদের মাপের শিল্পীরা আর এলেন না, এলেন ছেলে-মেয়ে, ভাইপো-ভাইঝি, অমুক কণ্ঠ তমুক কণ্ঠীরা। ১৯৮০ সালে উত্তমকুমারের প্রয়াণ বাংলা ছবিতে যে ভাটা আনল, গানের জগতেও তার ছাপ পড়ল। মুম্বই থেকে অভিনেতা, গায়কদের এনে শুধুমাত্র হিন্দি নাচ-গানের আসর বসানো শুরু হল। তার বিশাল মঞ্চ, আলোর চোখধাঁধানো সজ্জার আকর্ষণ ঘরোয়া জলসাকে ভুলিয়ে দিল। গান হয়ে উঠল ‘দেখার জিনিস’। হাতিবাগান থিয়েটার পাড়াতেও তার ছাপ পড়ল। ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’ বা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মতো নাটক সবিতাব্রত দত্ত, কেতকী দত্ত, নির্মলেন্দু চৌধুরীর গানের জন্য লোকে দেখতে আসত। থিয়েটারের জন্য মৌলিক গান লেখাও এ বার কমে গেল। এ দিকে লং প্লেয়িং (দশ-বারোটা গান) বা এক্সটেন্ডেড প্লেয়িং (চারটে গান) রেকর্ডের পর এল ক্যাসেট। অল্প টাকায় অনেকগুলি গানের ‘প্যাকেজ’-এর চাপে একটি রেকর্ডের দু’পিঠে দুটো ‘পুজোর গান’ হারিয়েই গেল। আর বাঙালির প্রিয় গানের জলসার অন্যতম মঞ্চ, একক পর্দার সিনেমা হল, আজ হয় বন্ধ, না হলে শপিং মল হয়ে গিয়েছে। পার্বতী-রাধা-ঝর্না-পারিজাত আজ অস্তিত্বহীন। সেই আঁধার-আড়াল থেকে যেন ভেসে
আসে হেমন্তের কণ্ঠ, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে...।’