Newsletter

চুনকালির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল

ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ‘বাবা’ অথবা ‘বাপু’ অথবা ‘গডম্যান’রা বরাবরই খুব প্রভাবশালী। এ দেশে আসলে দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনীতিকদের প্রভাব অপার।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৮ ১৮:১০
Share:

আসারাম বাপুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ছবি: পিটিআই

খুব জরুরি ছিল এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। পরীক্ষার মুখে ছিল দেশের বিচার বিভাগ। পরীক্ষার মুখে ছিল প্রশাসন। স্বঘোষিত ধর্মগুরু আসারাম বাপুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করে এবং রায়দান পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে আদালত এবং সরকার প্রমাণ করতে পারল, আইনের শাসনই শেষ কথা এবং নৈরাজ্যের কোনও আয়োজনকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

Advertisement

ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ‘বাবা’ অথবা ‘বাপু’ অথবা ‘গডম্যান’রা বরাবরই খুব প্রভাবশালী। এ দেশে আসলে দৈনন্দিন জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনীতিকদের প্রভাব অপার। আর ‘গডম্যান’দের প্রভাব রাজনীতিকদের উপরে অপার। কারণ এই স্বঘোষিত ‘ধর্মগুরু’ বা ‘উদ্ধারক’দের কথায় অনেক ভোট এ দিক-ও দিক হয়ে যায় অনেক এলাকাতেই। তথাকথিত এই গডম্যানদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠলে তাই সরকারের তথা রাজনীতিকদের বিড়ম্বনা হু হু করে বাড়তে থাকে।

গুরমিত রাম রহিম সিংহ নামে এক ব্যক্তি নিজেকে ‘ঈশ্বরের বার্তাবাহক’ বা ‘ঈশ্বরের দূত’ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। রমরমিয়ে চলছিল ‘আধ্যাত্মিক’ কারবার। কিন্তু বাধ সাধল সেই একই ধর্ষণের অভিযোগ। বহু রকম ভাবে মামলাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। তাই ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে এক ভয়ঙ্কর দিন দেখতে হয়েছিল। গুরমিত রাম রহিম সিংহকে আদালত অপরাধী সাব্যস্ত করতেই তীব্র হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল। রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল নেমেছিল। বিপুল অঙ্কের সম্পত্তিহানি হয়েছিল।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

রাম রহিম অনুগামীদের উন্মত্ত তাণ্ডব দেখিয়ে দিয়েছিল, সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ কী ভাবে প্রশাসনকে অসহায়-অকর্মণ্য বানিয়ে ফেলতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে রায় ঘোষণার অনেক আগে থেকেই যে কঠোর হাতে পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরা জরুরি ছিল, তা প্রশাসনিক কর্তারা জানতেন না, এমন সম্ভবত নয়। কিন্তু রাম রহিমের বিরুদ্ধে আদালতের কঠোর পদক্ষেপের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা সম্ভবত নিজেদের নাম জড়াতে চাননি। তাই রায় ঘোষণার কয়েক দিন আগে থেকে পঞ্চকুলায় স্রোতের মতো জড়ো হচ্ছিলেন রাম রহিমের যে অনুগামীরা, তাঁদের বাধা দেওয়া হয়নি। মর্মান্তিক ফলাফলটা কারও অজানা নয়।

রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্তা, প্রভাবশালী ‘ধর্মগুরু’— এঁদের মধ্যে যে এক অত্যন্ত অনৈতিক যোগসাজশ সর্বদাই চলতে থাকে, বলিউডি ছবির পর্দায় তা বহু বার দেখা গিয়েছে আগেও। কিন্তু বাস্তবে অতটা প্রকট ভাবে সেই অশুভ আঁতাত বোঝা যেত না। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় গডম্যান চন্দ্রস্বামী অত্যন্ত চর্চিত নাম হয়ে ওঠেন গোটা দেশে। কুখ্যাত অশুভ আঁতাতটা যে শুধু চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু নয়, বাস্তবেও যে তা অস্তিত্বশীল, সে বার খুব স্পষ্ট করে বোঝা গিয়েছিল সে কথা। তবে চন্দ্রস্বামীর গ্রেফতারি উত্তর পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দিয়েছিল তত্কালীন প্রশাসন। গুরমিত রাম রহিম সিংহের গ্রেফতারির পরে কিন্তু সামাল দেওয়া যায়নি। সামাল দেওয়ার বা আইনের শাসন বহাল রাখার ইচ্ছা পুরোপুরি ছিল কি না, তাও স্পষ্ট করে বোঝা যায়নি।

চন্দ্রস্বামীতে শুরু, আর এক লাফে রাম রহিমে পৌঁছে শেষ, বিষয়টা এমন নয়। মাঝেও অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে। কখনও স্বঘোষিত গুরু রামপালকে গ্রেফতার করতে গিয়ে প্রবল হিংসার সম্মুখীন হতে হয়েছে রাষ্ট্রকে। কখনও এই আসারামের আশ্রম থেকেই ওই একই রকম হিংসাত্মক অবরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। কখনও সমস্যা ঘনিয়েছে নির্মল বাবাকে নিয়ে। তবে রাম রহিমের সাজা ঘোষণা এবং গ্রেফতারি উত্তর পরিস্থিতি যে ভাবে চুনকালি দিয়েছিল প্রশাসনের মুখে, তা রাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর তো বটেই, ঘোরতর অসম্মানজনকও। আসারাম মামলার নিষ্পত্তির দিনে তাই সতর্ক থাকতেই হত প্রশাসনকে। ভোটব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার প্রশ্নে বিপুল রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক অনীহা থাকে— এই তত্ত্বকে অপ্রমাণ করার দায় ছিল রাষ্ট্রের উপরে। সে তত্ত্ব অপ্রমাণে রাষ্ট্র এ বার কিছুটা হলেও সফল।

অত্যন্ত জরুরি ছিল এই ছবিটা তৈরি হওয়া। আসারামের বিরুদ্ধে আদালতের রায় ঘোষিত হওয়ার পরে নির্যাতিতার বাবা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, তিনি ন্যায় পেয়েছেন। প্রশানিক অনীহা বা রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা এই ন্যায়ের উপলব্ধিকে ম্লান করে দিতে পারত। সুবিচার পাওয়ার জন্য সাধারণ নাগরিকের এক মাত্র ভরসা আদালত, প্রশাসনের উপর বিন্দুমাত্র আস্থা রাখা যায় না— এই তত্ত্ব আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হত। সেই গ্লানি থেকে আপাতত বেঁচে গেল আমাদের রাষ্ট্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন