ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট দ্বৈরথ মানেই এখন গোটা উপমহাদেশে নকল যুদ্ধের মহড়া। এবং ব্যাপক অশান্তি। সাম্প্রতিক সরকারি জাতীয়তাবাদের জোয়ার সেই মহড়াকে সর্বতোভাবে প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিতে ব্যস্ত, তাই অশান্তিও ক্রমবর্ধমান। এ বার ভারত পাকিস্তান ফাইনালের সম্ভাবনা তৈরি হওয়া মাত্র দেখা গেল, কাশ্মীর উপত্যকা আবার ক্ষোভে ফুটিতেছে। ছাত্রছাত্রী পথচারীদের মুখে যত্রতত্র পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান, পাকিস্তানের পতাকা-সহ আবেগ প্রদর্শন। ক্ষোভের রাজনীতিকে কাজে লাগাইতে মুহূর্তেকও সময় লাগে না। সুতরাং আগাইয়া আসিলেন হুরিয়ত চেয়ারপার্সন মিরওয়াইজ উমর ফারুক, পাকিস্তানের ভূরি ভূরি প্রশংসা ও শুভেচ্ছা পাঠাইয়া তাঁহার সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করিতে শুরু করিলেন। ভারত-বিরোধিতা মানেই যেখানে পাকিস্তান-জয়গান এবং যে কোনও ক্ষোভেরই অবধারিত প্রকাশ যেখানে ভারত-বিরোধিতার মধ্যে, সেখানে এমনই ঘটিবার কথা। গোটা পরিস্থিতির মধ্যে যে অপরিমেয় বিষাদের হেতু, এই অকারণ ও অবান্তর পাকিস্তানপ্রীতি প্রদর্শন তাহা আবারও স্পষ্ট করিয়া দেয়। জম্মু ও কাশ্মীর নামক ভারতীয় অঙ্গরাজ্যটির অধিকার লইয়া ভারতীয় রাষ্ট্র যতই সংবেদনশীল হউক, প্রতি দিন প্রতি উপলক্ষে নূতন ভাবে প্রমাণিত যে, সাধারণ কাশ্মীরিরা ভারতীয় রাষ্ট্র হইতে মানসিক ভাবে বহু দূরে চলিয়া গিয়াছেন। একটি সামান্য ক্রিকেট ম্যাচও এখানে রাষ্ট্রবিরোধিতার প্রবল প্রস্তুতিতে পূর্ণ। বিনোদনও আপাদমস্তক রাজনৈতিক: নেতি-রাজনীতির পরিসর।
স্বভাবতই রাজ্য সরকারের অন্যতম শরিক দল বিজেপি ছাড়িয়া কথা বলিতে রাজি নহে। অপর শরিক পিডিপির নেতা প্রকাশ্যে মিরওয়াইজ ফারুকের সমালোচনা, এবং সংকীর্ণ রাজনীতিতে অশান্তি তৈরির প্রয়াসের নিন্দা করা মাত্র বিজেপি মহোৎসাহে মাঠে নামিয়া পড়িল ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগের বস্তা লইয়া। সকল পাক পতাকা-বাহী কাশ্মীরি তরুণরা আসলে দেশদ্রোহী, জাতীয়তাবিরোধী, তাহাদের শাস্তি দরকার, ইত্যাদি গরম হুমকিতে পরিবেশ এখন যারপরনাই উত্তপ্ত। প্রসঙ্গত ২০১৪ সালে মেরঠ মনে পড়িতে পারে। সেখানে এক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ক্রিকেটে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিজয়ে উল্লাস করায় ষাট জন কাশ্মীরি যুবককে মারিয়া বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর হইতে বহিষ্কার করিয়া দিল্লি পাঠাইয়া দেওয়া হয়।
সমস্যাটি জটিল, বিশেষ ধৈর্যসহকারে ইহার মীমাংসা জরুরি। প্রথম প্রশ্ন, খেলার মধ্যে কেন রাজনীতি, বিশেষত প্রতিযোগিতামূলক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ঢুকিবে? এই প্রবণতা অত্যন্ত নিন্দার্হ, অতি সংকীর্ণ মানসিকতার প্রকাশ। কিন্তু এহেন নিয়মমাফিক নিন্দাবাক্য উচ্চারণ বড়ই অর্থহীন, উপমহাদেশে এই ট্র্যাডিশনই চলিবে, বিস্তার লাভ করিবে। সে ক্ষেত্রে ভাবা দরকার, কী ভাবে ইহার মোকাবিলা সম্ভব। মারিয়া, গ্রেফতার করিয়া, ভয় দেখাইয়া কত মানুষকে আটকানো যায়? তাহার বদলে এই সব বক্তব্য অবজ্ঞা করাই কি ভাল নয়? কাশ্মীরের বিরোধী দল ন্যাশনাল কনফারেন্স সঙ্গত ভাবে মনে করাইয়াছে, স্লোগান দেওয়া, পতাকা তোলা, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁড়াইয়া ভারতের কাশ্মীর নীতির মুণ্ডপাত করা, এ সবও কিন্তু গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা। ভাল না লাগিলেও বিষয়গুলিকে সেই ভাবেই দেখিতে হইবে। যত ক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি সংঘর্ষে গড়াইতেছে না, দ্রোহ বা দেশদ্রোহ, কোনও অভিযোগই দাঁড়ায় না। বিশেষত ব্রিটিশ আমলের দেশদ্রোহ দমনমূলক আইনটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের ক্ষেত্রে কতখানি প্রযোজ্য, এবং কাশ্মীরের মতো ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য, তাহা গুরুতর বিবেচনার বিষয়। বিজেপি সরকার যদি মনে করে, বিবেচনা বাদ দিয়া কেবল গণপিটুনির পথটিই প্রশস্ত, তবে গণতন্ত্র তো অকালে মরিবেই, দেশও বেশি দিন বাঁচিবে না।