এক বৎসর পূর্বেই সুপ্রিম কোর্ট জানাইয়া দিয়াছিল, ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত। সাইবার-পরিসরে নজরদারির কাহিনিটি সেই রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফুরাইয়া যাওয়ার কথা ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার জানাইল, এত সহজে হাল ছাড়িতে নাই। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ঘোষণা করিল, যে কোনও ব্যক্তির কম্পিউটারে (এবং মোবাইল ফোনে) নজরদারি করিবার অধিকার পাইতেছে দশটি সংস্থা। শোনা যাইতেছে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও নজরদারি বাড়াইবার ব্যবস্থা করিবে সরকার। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সবই দেশের স্বার্থে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার তাগিদে। ইতিমধ্যেই এই ঘোষণার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হইয়াছে। শীর্ষ আদালতের ধোপে এই নজরদারির আদেশ টিকিবে কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু, অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদীরা জানেন, মামলা শুধু আইনের আদালতেই চলিবে না। জনতাও রায় দিবে। সেই এজলাসে আইনের যুক্তি অচল, তাহা আবেগে চলে। এখানেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার যুক্তিটি মোক্ষম। শীর্ষ আদালত যদি এই নজরদারির সিদ্ধান্তকে ছাড়পত্র দেয়, তবে তো কথাই নাই— ‘বলিষ্ঠ’ সরকারের ‘দৃঢ়’ সিদ্ধান্তের ঢাকের বাদ্য চতুর্দিকে শোনা যাইবে। নজরদারির অত্যুৎসাহটি যদি আদালতের রায়ে আটকাইয়া যায়, তাহা হইলেও বলা যাইবে, ‘দেশের স্বার্থে’ নরেন্দ্র মোদী চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’দের এমনই প্রতাপ যে দেশের স্বার্থটিকে যমুনার ঘোলা জলে বিসর্জন দিতে হইল।
স্বভাবতই অভিযোগ উঠিতেছে, বিরোধীদের চাপে রাখিতেই এই নজরদারির ব্যবস্থা। ব্যক্তিপরিসরেও যাহাতে কেহ এই সরকারের বিরুদ্ধে সরব না হইতে পারে, লড়াইয়ের প্রস্তুতি না লইতে পারে, নরেন্দ্র মোদীরা তাহাই নিশ্চিত করিতে চাহিতেছেন। এই অভিযোগ খণ্ডনের কোনও দায় কার্যত নরেন্দ্র মোদীদের নাই, কারণ সরকারের এবং রাষ্ট্রের অভিন্নতা তাঁহারা প্রতিষ্ঠা করিয়া ফেলিয়াছেন, এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাহা মানিয়াও লইয়াছে। সুধা ভরদ্বাজদের গ্রেফতারি যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার জন্য নহে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে; কানহাইয়া কুমারদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও সেই রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নিশ্চিত করিতেই; এনআরসি-ও সংখ্যালঘুদের প্যাঁচে ফেলিবার জন্য নহে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে— নরেন্দ্র মোদীরা বলিয়াছেন, এবং দেশের বহু মানুষ বিশ্বাসও করিয়াছেন। ফলে, রাহুল গাঁধীর টুইটের প্রত্যুত্তরে অমিত শাহ যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গটিকেই গুরুত্ব দিবেন, তাহাতে অবাক হইবার কোনও কারণ নাই।
অরুণ জেটলি সংসদে বলিয়াছেন, বিরোধীদের হইচই অনর্থক, কারণ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অধীনে এই নজরদারির ব্যবস্থাটি হইয়াছিল ইউপিএ সরকারের আমলে। তাঁহারা সেই আইন প্রয়োগ করিবার নির্দেশ দিতেছেন মাত্র। জেটলি জানান নাই, নজরদারির আন্তরিক তাগিদ না থাকিলে সাড়ে চার বৎসরে তাঁহারা এই আইনটিকে বাতিল করেন নাই কেন? এত দিনেও কেন এক বারও শোনা যায় নাই যে তাঁহারা এই নজরদারির আইনের বিরোধী? বরং, নজরদারিতে যে তাঁহাদের আগ্রহ বিপুল, বহু বার তাহা বোঝা গিয়াছে— সুপ্রিম কোর্টে ব্যক্তিপরিসরের গোপনীয়তার অধিকার সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে তো বটেই। এবং, জেটলি এই কথাটিও বলেন নাই যে আইন থাকা এবং তাহার প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে ফারাক অনতিক্রম্য। ঘুড়ি উড়াইতে হইলে লাইসেন্স লাগিবে, এমন একটি আইনও আছে। জেটলিরা নিশ্চয় তাহা প্রয়োগ করিবার কথা ভাবেন নাই। কারণ, তাঁহারা জানেন, আইন থাকিলেই তাহাকে প্রয়োগ করিতে হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নাই। অতঃপর, আইনটি ইউপিএ-র তৈরি, এই যুক্তিটি আর ব্যবহার্য থাকে কি?