প্রশ্ন: ম্যাজিক মোমেন্টস অব নকশালবাড়ি আপনার দিকনির্ণয়ী গ্রন্থের জন্য আপনি এই চমকপ্রদ শিরোনামটি বেছে নিলেন কেন?
মল্লারিকা সিংহরায়: গবেষণা চলাকালীন আমি বেশ কয়েক জন অঙ্গীরকারবদ্ধ নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। এদেরই এক জন স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, ‘সেই আশ্চর্য সময়’।
আমি ভেবেছিলাম ‘আশ্চর্য সময়’-এর ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনা ‘ম্যাজিক মোমেন্টস’ শব্দবন্ধে যথাযথ প্রকাশ পাবে। উপরন্তু, ১৯৮৯-এ লেখা এক নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘দ্যাট ম্যাজিক টাইম, উইমেন ইন তেলঙ্গানা পিপলস স্ট্রাগল’। এটাও আমাকে প্রভাবিত করেছিল।
প্র: আপনি প্রথম গবেষক বা ইতিহাসবিদ, যিনি আন্দোলন বা বিপ্লবটিকে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে একটি সমগ্র বই লিখেছেন। পুরুষরা এই জেন্ডারড অ্যাকাউন্ট-এর ধারেকাছেও আসেনি কেন? খণ্ডিত দৃষ্টি না নিছক পুরুষালি শ্যভিনিজম?
উ: আমার প্রকাশিত কাজের পরে বেশ কিছু তরুণ-তরুণী জেনডারড ইভলিউশন বা লিঙ্গ মূল্যায়নের দায়িত্বটি নিষ্ঠাভরে পালন করে চলেছেন। তাঁদের এই প্রয়াসের সঙ্গে আমিও যুক্ত। তবে, আমার আগে যাঁরা এ বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন, তাঁরাও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত পেশ করছি। আমরা অনেকেই একনিষ্ঠ গবেষক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের সঙ্গে পরিচিত। নকশালবাড়ি আন্দোলনের বিষয়ে তিনি দুটি অসামান্য বই লিখেছেন, কিন্তু তাঁর প্রয়াসেও নারীর ভূমিকা ও লিঙ্গভিত্তিক বিবরণ স্থান পায়নি।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় উঠে আসে। তা হল নকশালপন্থী কর্তৃক বেঙ্গল রেনেসাঁস বা নবযুগের কঠোর আদ্যন্ত সমালোচনা। এই সমালোচনার সময় বিপ্লবীরা উপনিবেশ পর্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রপদক্ষেপকে মূল্যই দেননি। যেমন বিধবা বিবাহ, স্ত্রী শিক্ষার প্রবর্তন, সতীদাহের প্রবল বিরোধিতা। এই নীরবতাকে আমি খণ্ডন করেছি এবং বোঝাতে চেয়েছি যে নকশালবাদী নারীসংগ্রামীদের ভূমিকা ও অবস্থানকে অতীতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, কারণ সব কিছুরই একটা ইতিহাস আছে।
প্র: নারীদের উজ্জ্বল অবদান স্মরণে রেখে আমরা কি কোনও ‘বিকল্প’ ইতিহাস নির্মাণ করতে পারি?
উ: আমি প্রথমেই বলে নিতে চাই যে নারী-নায়িকাদের ওপর আলোকপাত করে আমি কোনও বিকল্প ইতিহাস নির্মাণ করতে চাইনি। পক্ষান্তরে, আমি সেই প্রক্রিয়াটি অনুধাবন করতে চেয়েছি, যার সীমিত পরিণতি হল শুধু নায়ক-নির্মাণ। একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত পেশ করছি। আমরা অনেকেই পঞ্জাব রাও-এর বীরত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু এই নায়কের স্ত্রী কৃষ্ণমায়ার অবদান সম্পর্কে অবহিত নই। তাই, আমি বুঝতে চেয়েছি কী ভাবে ও কেন এই পুরুষনির্ভর আখ্যান গড়ে উঠেছিল। আমি সত্যি খুশি হব যদি কেউ কৃষ্ণমায়ার অংশগ্রহণের ওপর আলোকপাত করে। এই কাজটি সম্পূর্ণ হলেই দুটি আখ্যান পাশাপাশি রেখে ও পড়ে একটি সামগ্রিক চিত্র উদ্ধারে সক্ষম হব। আমি বলব না গবেষকরা জেনেশুনে ইচ্ছা করে নারীদের বাদ দিয়েছেন। আসলে, লিঙ্গভেদের গুরুত্ব সম্পর্কেই তাঁদের সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। এই ধারণার উন্মেষ ঘটলেই পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার কাজটি সম্পন্ন করতে পারব।
প্র: বেশ কিছু বিশ্লেষক নারী ও পুরুষের ভিন্নতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, যেখানে পুরুষরা চিন্তা-যুক্তি-বিতর্কের মাধ্যমে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছয়, সেখানে নারীদের অনুপ্রাণিত করে এক ধরনের সার্বিক অনুভবময়তা। যুক্তি বা লজিক এবং অনুভব বা ইমোশন-এর ভিতর এই ধরনের বিভাজন নির্মাণ কি সংগত?
উ: আসলে নারীত্ব অর্থাৎ ফেমিনিটি এবং আবেগের ভিতর যোগসূত্রটিকে এতটাই স্বাভাবিক মনে করা হয়ে থাকে যে অনেক সময় আমরা এই সংযোগের যথোপযুক্ত বিশ্লেষণই করি না। তদুপরি, যখন আমরা এই আপাত সহজ পার্থক্যটিকে মাসকুলাইন/ফেমিনাইন বিভাজনটির সঙ্গে যুক্ত করতে সচেষ্ট হই, তখনই নারীদের অনুভবময় অঙ্গীকার তার গুরুত্ব হারায়। এই চিন্তার প্রক্রিয়াটিই ভ্রান্ত। নারীবাদী দার্শনিকেরা এই অতিসরল বিভাজনটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে যুক্তি ও আবেগের ভিতর এই ধরনের প্রাচীর তৈরি সম্ভব নয়, অভিপ্রেতও নয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, নারীরা যুক্তি এবং আবেগের যৌথ তাড়নায় বিপ্লবী হিংসায় অংশ নিয়েছিলেন। পুরুষ বিপ্লবীরা কিন্তু নারীদের এই কর্মময়তাকে সুনজরে দেখেননি। তাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন। পুরুষতন্ত্রের প্রভাবের ফলে তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন যে নারীরা হবেন ভিক্টিম বা ভুক্তভোগী, অথবা পুরুষদের নির্দেশ অনুসারেই তাঁরা কাজ করবেন। এর বাইরে গেলেই বিপ্লবের প্রচলিত লিঙ্গভেদটি বিঘ্নিত হয় বা হবে।
প্র: নকশালবাড়ি অনুপ্রাণিত সৃজনকর্মের গভীরে প্রবেশ করেছেন আপনিও এই। সাহিত্যসৃজনে কিন্তু নারীদের প্রতি অন্তরের সম্মানজ্ঞাপন করা হয়েছে, তাদের অনুভবসর্বস্বতায় সীমিত করা হয়নি...
উ: আমি গবেষণার বিষয়টি বেছে নিই নকশালবাড়ি দ্বারা অনুপ্রাণিত কবিতা, উপন্যাস, নাটক পড়ে। এই সাহিত্যের বইগুলিতে নারীদের যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে সমাজবিজ্ঞানের প্রাঙ্গণে বা অ্যাকাডেমিক লেখায় তারা কার্যত অনুপস্থিত। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, কেন এমনটি হল? এক জন সৃষ্টিশীল লেখকের হাতে নকশালরমণী কেন পূর্ণ মর্যাদা পেল, যেখানে পুরুষ কমরেড তাকে যোগ্য শিরোপা দিতে অপারগ। এই মূল প্রশ্নটি আমাকে গবেষণার দিকে অনেকটা নিয়ে যায়। তার পর স্মৃতির অপরিহার্য ভূমিকা, স্মৃতি ও ইতিহাসের ভিতর সম্পর্ক-নিরূপণ আমাকে আরও একাগ্র
করে তোলে।
প্র: নিশ্চয়ই আপনি বিরাট পরিশ্রম করেছেন আপনার বর্তমান অবস্থানে আসার জন্য?
উ: এই শতাব্দীর গোড়ায় এমফিল-এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তখন থেকেই বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হই। আমাকে প্রভাবিত করে একাধিক নকশাল নারীর স্মৃতিচারণ ও আত্মকথা। তার পর গবেষণার জন্য এই বিষয়টি বেছে নিই; পড়াশোনা করি দিল্লিতে ও অক্সফোর্ডে। এক দশকের বেশি সময় ধরে অ্যাকাডেমির প্রাঙ্গণে সক্রিয় রাজনৈতিক নারীকে যোগ্যস্থান প্রদানই আমার লক্ষ্য ও অভিলাষ।
সাক্ষাৎকার: শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত