corona virus

মৃত্যুর চেয়ে বড়

নোভেল করোনাভাইরাস-বাহিত অতিমারি আসিয়া মানুষের মৃত্যুবোধকে অনেক সন্নিকটে আনিয়া দিয়াছে। যে মানুষ আগামী বিশ বৎসর কেমন ভাবে টাকা কামাইবেন ভাবিতে মগ্ন ছিলেন, তাঁহাকেও সচকিত করিয়া বলিয়াছে, ঈশ্বর না করুন, কিন্তু তোমার সময় ঘনাইয়া আসিতে পারে কাল, অথবা পরশু।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০০:০৫
Share:

বিখ্যাত লেখক হোর্হে লুই বোর্হেস লিখিয়াছিলেন, মানুষ ব্যতীত সব প্রাণীই অমর, কারণ তাহারা জানেই না যে তাহাদের মৃত্যু হইবে। কোন প্রাণী সত্যই কী জানে বা জানে না, তাহা জল্পনার বিষয়। কিন্তু ইহা অনস্বীকার্য যে, মানুষের নশ্বরতাজ্ঞান তাহাকে প্রবল বিপদে ফেলিয়াছে। জীবন যে অনিত্য, এই ভয়ানক সত্যটি কখনও তাহাকে ছাড়িয়া যায় না। তাহার প্রতিটি দিবসরাত্রি হইয়া দাঁড়ায় এই কথাটি ভুলিয়া থাকিবার একটি প্রকল্প। অথবা, শারীরিক মৃত্যু আসিয়াও অস্তিত্বের বিলোপ যাহাতে না করিতে পারে, তাহার প্রয়াস। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক অ্যান্টনি বার্জেসকে যখন ডাক্তার বলিয়াছিলেন, তাঁহার কঠিন অসুখ করিয়াছে, আয়ু খুব বেশি হইলে আর একটি বৎসর, (তখনও তিনি বিখ্যাত হন নাই) তিনি বাড়ি আসিয়াই প্রবল শ্রমে ও পূর্ণ মনোযোগে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, এক বৎসরে অনেকগুলি উপন্যাস লিখিয়া ফেলিয়াছিলেন। যদিও তিনি বলিয়াছিলেন, তাঁহার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, ভাবী বিধবা স্ত্রীর সংস্থানের কিঞ্চিৎ বন্দোবস্ত করিয়া যাওয়া, কিন্তু বুঝিতে অসুবিধা হয় না যে, এক শিল্পীর প্রধান চিন্তা তাঁহার অক্ষয় কীর্তি এই ধরাধামে রাখিয়া যাওয়া। তাহার পর যদিও অ্যান্টনি বাঁচিয়াছিলেন আরও বহু বৎসর, কিন্তু কাহিনিটি হইতে এই নীতি আহরণ করিতে হইবে, মানুষের বর্ধিত অধ্যবসায় ও কাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও মৃত্যুভয়েরই অন্যতম দান হইতে পারে। নোভেল করোনাভাইরাস-বাহিত অতিমারি আসিয়া মানুষের মৃত্যুবোধকে অনেক সন্নিকটে আনিয়া দিয়াছে। যে মানুষ আগামী বিশ বৎসর কেমন ভাবে টাকা কামাইবেন ভাবিতে মগ্ন ছিলেন, তাঁহাকেও সচকিত করিয়া বলিয়াছে, ঈশ্বর না করুন, কিন্তু তোমার সময় ঘনাইয়া আসিতে পারে কাল, অথবা পরশু। ফলে অত্যাবশ্যক কাজগুলি সারিয়া রাখিবার লগ্ন ইহাই। কাহারও অতি প্রিয়জনকে অতিমারি লইয়া যাইতেছে। জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিলকে এক চিঠিতে লিখিয়ছিলেন, প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের দায়িত্ববোধ বাড়াইয়া দেয়, যিনি চলিয়া গেলেন তাঁহার অনারব্ধ কাজ সমাপ্ত করিবার দায় আমাদের বহন করিতে হয় (এবং সেই কারণেই এই বিচ্ছেদ মহৎ)। সাধারণ মানুষ এমন দার্শনিকতায় আচ্ছন্ন থাকেন না হয়তো, কিন্তু কেহ যদি এই করোনা-কালে নিজের বা প্রিয়জনের অসম্পূর্ণ কাজ সুসম্পন্ন করিবার জন্য উঠিয়াপড়িয়া লাগেন, তাহা হইলে উহা অতিমারিরই সুফল, সঙ্কটজনিত তাড়না এখানে প্রেরণা। সাধে তো প্লেগের কালে শেক্সপিয়র এতগুলি নাটক লিখেন নাই, নিউটন কঠিন সমীকরণ আবিষ্কার করেন নাই।

Advertisement

কিন্তু, যেমনটি টুইটারে নির্দেশ করা হইয়াছে, শেক্সপিয়র বা নিউটনের বাড়িতে ওয়েব সিরিজ় দেখিবার সুবন্দোবস্ত ছিল না। তদুপরি, কারণ বর্তমান যুগে আলস্যকে প্রশ্রয় না দিবার শিক্ষা প্রচারিত নহে, বরং বাড়িতে বসিয়া টিভির প্রদর্শনীর প্রতি নিমীলিত নয়ন মেলিয়া থাকাই পরমতম অভীষ্ট বলিয়া নির্ণীত। তদুপরি স্মরণীয় ধর্মবকের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠিরের মহাবাক্য, প্রত্যহই প্রাণীগণের মৃত্যু হইতেছে, তথাপি অবশিষ্টেরা চিরকাল বাঁচিতে চাহে, ইহার অপেক্ষা আশ্চর্য আর কী হইতে পারে। ইহার অপেক্ষা আশ্চর্য হইল, মানুষ আসলে ভাবে, তাহার মৃত্যু হইবে না। আজ অতিমারিতে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর খবর টিভিতে প্রতি সন্ধ্যায় স্তম্ভিত ও ভীত করিতেছে, তথাপি অনেকেই ভাবিতেছে, এই অদৃষ্ট তাহার হইবে না। তাই তীব্র মৃত্যুভয়ে উন্মত্ত কর্মোদ্যোগে ব্যাপৃত হইবারও প্রশ্ন নাই, জড় স্থাণু নির্বেদে আবৃত হইবারও সম্ভাবনা নাই। মানুষ হুবহু তাহাই করিতেছে, যাহা সে যে কোনও ছুটি পাইলে করে। হয় ছাদে নৃত্য করিয়া ফেসবুকে তুলিতেছে, নয় ফেসবুকে অন্যের ছাদ-নৃত্য দেখিতেছে। মৃত্যুভয় নিতান্ত পরাজিত হইয়া হাঁপ টানিতেছে। সে চিন্তাক্লীব মানুষের পাল্লায় পড়িয়াছে, কেহই জীবনের অর্থ খুঁজিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িবে না। অবশ্য বিশেষজ্ঞরাও বলিতেছেন, জীবন শেষ হইয়া আসিলে তাহাকে যেমন করিয়া হউক হেঁচড়াইতে হেঁচড়াইতে গভীর তাৎপর্যের প্রাঙ্গণে আনিয়া ফেলিতে হইবে, ইহা অপরিণত দৃষ্টিভঙ্গি। জীবনের মুহূর্তগুলিকে কীর্তিপ্রসব ও লভ্যাংশ দিয়াই পরিমাপ করিতে হইবে, কে বলিল। বরং কেহ ভাবিতেই পারে, জীবনের যখন বেশি ক্ষণ অবশিষ্ট নাই, তখন সিরিয়াল দেখিয়া ও ফুচকা খাইয়া সময়টুকু কাটাইয়া দিই। কিছুই যখন থাকিবে না, তখন আকুল ছন্দ মিলাইবার চেষ্টা নির্বুদ্ধিতা ব্যতীত কিছু নহে। এই ভাবে হাইয়ের সম্মুখে তুড়ি মারিতে গিয়াই মানুষ মৃত্যুর মুখে তুড়ি বাজাইয়া, জিতিয়া গেল।

যৎকিঞ্চিৎ

Advertisement

অস্ট্রেলিয়ার ‘নেবার্স’ সিরিয়াল চলছে ৩৫ বছর ধরে, তার শুটিং শুরু হয়ে গেল এপ্রিলের শেষ থেকেই। করোনার দাপটে সিরিয়ালে প্রকাণ্ড পরিবর্তন। আর তো দৈহিক ঘনিষ্ঠতা চলবে না, এমনকি ঘুসোঘুসিও বারণ। ফলে নায়ক নায়িকা ভিলেন, সবাই সম্মানজনক দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রেমে বা ঘৃণায় ভাজা-ভাজা হচ্ছেন। আর ভারতে কত দিন আগে থেকেই, যুগলে চুমু খাওয়ার জোগাড় দেখলেই, তুরন্ত কাট, অমনি দুটি ফুলে ঢলে ঢলে ছোঁয়াছুঁয়ি। বন্যেরা বনে সুন্দর, সেন্সর বোর্ড করোনায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন