প্রতীকী ছবি
দুই দশকের ঔপনিবেশিক সম্পর্কও যাহা পারে নাই, করোনাভাইরাস অনায়াসে তাহা করিয়া ফেলিল। ইত্যবসরে ভারতের একান্ত নিজস্ব সৌজন্য বিনিময়ের রীতিটি শিখিয়া ফেলিল ইংরাজ জাতি। যুবরাজের ট্রাস্টের এক অনুষ্ঠানে দেখা যাইল, করমর্দন করিতে গিয়াও তৎক্ষণাৎ পিছাইয়া আসিলেন যুবরাজ চার্লস, পর ক্ষণেই একটি নমস্কারে সৌহার্দ্য জ্ঞাপনের কাজটি সারিলেন। করোনাভাইরাস অবশ্য প্রতিনিয়তই অসাধ্যসাধন করিতেছে। আফ্রিকা মহাদেশ যে ইউরোপীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ করিতে পারে, ইহা কখনও ভাবা গিয়াছিল? কিংবা রাস্তাঘাটে শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি দেখিলে ভারতীয়েরা উল্লসিত হইবার পরিবর্তে ভীত হইবেন, ইহাও কিছু দিন পূর্বে অবধি কষ্টকল্পনাই ছিল। তবে সকল ইংরাজ ভারতীয় রীতিকে এত খুশি মনে মানিয়া লইতে রাজি হন নাই। অনুষ্ঠানের সঞ্চালকগণ করমর্দনের পরিবর্তে হিলশেক অর্থাৎ গোড়ালি নাড়াইয়া সৌজন্য বিনিময়ের রীতি প্রদর্শন করেন। তবে ওই রীতি অবাস্তব তো বটেই, পরিশীলিত নমস্কারের সঙ্গে কোনও মতে তুলনীয়ও নহে।
অস্বীকার করিলে চলিবে না, বহু স্পর্শহীন সৌজন্য বিনিময় রীতির ন্যায় নমস্কারও অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত। পাশ্চাত্য বাদ দিলে অপরাপর দেশে যুগ যুগ ধরিয়া স্পর্শহীন সৌজন্য বিনিময় রীতি প্রচলিত। উদাহরণ হিসাবে দক্ষিণ এশীয় মুসলমানদের আদাব কিংবা পূর্ব এশীয় জনতার বাও করা বা ঝুঁকিবার রীতি উল্লেখ করা যাইতে পারে। ভারতের ন্যায় যে ভৌগোলিক অঞ্চল অনাদিকাল ধরিয়া সংক্রামক ব্যাধির আঁতুড়ঘর, সেই স্থলে এই রীতি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভিমুখ হইতেও তাৎপর্যপূর্ণ। ইহার বিরুদ্ধ-যুক্তিও আছে। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, অস্পৃশ্যতার সামাজিক বন্দোবস্তের সূত্রেই নাকি এই স্পর্শহীন রীতির জন্ম। তবে ইহা বিশ্বাস করা কঠিন। আমাদের জাতপাত এতখানিও যুক্তিপূর্ণ নহে। অস্পৃশ্যতার সূত্রে স্পর্শশূন্য সৌজন্য বিনিময় হইবে আর সেইখানে নিচুর প্রতি উঁচু জাতের কোনও অশিষ্ট আচরণের নিদান থাকিবে না, ইহাও সম্ভব? বিপ্রতীপে, নমস্কারের ভঙ্গি ও ভাবনা এতই কমনীয় ও দার্শনিক, যে তাহা ব্রিটিশ রাজপরিবারেও দিব্য খাপ খাইয়া যাইতেছে। প্রভুত্বের ইতিহাস কার্যত বিস্মৃত হইয়াই হাতের পাতা বা আংটি চুম্বন রীতি বিসর্জন দিয়াছেন তাঁহারা।
কেবল যুবরাজ চার্লসই ভারতপথের পথিক নহেন। ইজ়রায়েলে করোনাভাইরাস ছড়াইয়া পড়িবার পর এক বক্তৃতায় নমস্কার রীতির প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নমস্কার গ্রহণ করিয়াছেন। পরসংস্কৃতিসহিষ্ণু বলিয়া নেতানিয়াহু বা ট্রাম্পের সুনাম নাই। ইতিপূর্বে তাঁহারা কোনও ভিন দেশি সংস্কৃতি গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়াও শুনা যায় নাই। কিন্তু করোনাঝড়ে যখন কাক মরিতেছে, তখন হিন্দুত্ববাদী ফকিরেরা কেরামতি লইবেন না, তাহাও কি হয়? সত্যাসত্য বুঝিবার নিমিত্ত দুইটি বিষয় স্মরণে রাখা আবশ্যক। প্রথমত, বর্তমানে বিশ্ব জুড়িয়া ভারতীয়দের উপস্থিতি যথেষ্ট সরব, অন্তত নিজস্ব পরিচিতির নিরিখে। দ্বিতীয়ত, কোনও রাষ্ট্রপ্রধানই স্বেচ্ছায় নমস্কারকে গ্রহণ করেন নাই, করিয়াছেন অতিমারির ক্রমবর্ধমান আতঙ্কে। অতএব, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নমস্কারের প্রচলনকে হিন্দুত্ববাদের জয় বলিয়া প্রচার করিবার পরিবর্তে যথাযথ যুক্তিক্রম বুঝিয়া লওয়া বিধেয়।