প্রতীকী ছবি।
বিশ্ব জুড়ে মানুষ করোনা বা কোভিড-১৯ আতঙ্কে সন্ত্রস্ত। এই মারণ ব্যাধির প্রকোপ এখন আর শুধু চিনে সীমাবদ্ধ নয়। ইতালি রীতিমতো বিপর্যস্ত, স্পেন এবং ইরান যথাসাধ্য চেষ্টা করছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। এই অবস্থায় ভারতবর্ষ আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে। গত ডিসেম্বরে এই রোগ প্রথম চিনে দেখা দেয়। দুই মাসের মধ্যেই মহামারীর আকার ধারণ করে। ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এক মাসের মধ্যে এই রোগ প্রায় সমগ্র ইউরোপকে নিজের ঘেরাটোপে বন্দি করেছে। আমেরিকাও এই রোগে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। ভারতবর্ষে ৩০ জানুয়ারি প্রথম কেরলে কোভিড-১৯ রোগী ধরা পড়ে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২২ মার্চ অব্দি প্রায় ৩৬০ জন ভারতীয় এই ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং তার মধ্যে সাতজন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন।
এই অবস্থায় এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২২ মার্চ ‘জনতা কার্ফু’ ঘোষণা করে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই কার্ফুতে অংশগ্রহণও করেছেন। তবে সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, একদিনের কার্ফু কি কোভিড-১৯ রুখতে যথেষ্ট। এক কথায় উত্তর দিতে হলে বলতে হয় যে, না। একদিনের কার্ফু যথেষ্ট নয়।
ভাইরাস গবেষকদের মতে, রোগটি এখনও ভারতবর্ষে দ্বিতীয পর্যায়েই রয়েছে। অর্থাৎ এখনও গোষ্ঠী সংক্রমণ, যাকে যে কোনও ছোঁয়াচে রোগের তৃতীয় পর্যায়ে বলা হয়ে থাকে, শুরু হয়নি। তাই রোগটিকে এখানেই রুখে দেয়া উচিত। তবে, একবার যদি গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়, তাহলে ভারতবর্ষের মতো দেশে এই রোগ আটকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতের জনঘনত্ব খুব বেশি। চিকিৎসা পরিকাঠামো বিশ্ব মানের নয়।
তাহলে আমরা এক নজরে দেখে নিই, এই ভয়ানক পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমাদের এবং দেশের সরকারের কী কি করা উচিত:
১. অবিলম্বে রোগ পরীক্ষার মাপকাঠি শিথিল করতে হবে। এখনও শুধুমাত্র যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন বা সংক্রমিত লোকের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদেরকেই পরীক্ষা করা হচ্ছিল। সরকারের উচিত, তাঁদের সকলের রোগ পরীক্ষা করা যাঁদের মধ্যে কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক লক্ষণ বর্তমান। তাই বেসরকারি পরীক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা রাতারাতি বাড়াতে হবে। এখানে মনে রাখা উচিত যে অনেক গবেষকই এই মত প্রকাশ করেছেন যে সরকারি সংখ্যা থেকে সত্যিকারের সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।
২. যদি সরকার দীর্ঘায়িত লকডাউন ঘোষণা করে এবং তা করাই উচিত, তা হলে অর্থনৈতিক ভাবে সবচেয়ে আক্রান্ত হবেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা। তাই তাঁদের জন্য সরকারকে একটি কার্যকর অর্থনৈতিক প্যাকেজ তৈরী করতে হবে।
৩. যদিও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী একটি অর্থনৈতিক টাস্ক ফোর্সের গঠন করেছেন, এই টাস্ক ফোর্স এখনও অবধি কাজ শুরু করেনি। অতি দ্রুত এই টাস্ক ফোর্সের উচিত, করোনা-উত্তর পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা বানানো।
৪. কেরালা, যেখানে ভারতবর্ষের প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শণাক্ত হয়, নিজের সব সীমানা সিল করে দিয়েছে। পুরো দেশে অবিলম্বে তাই করা উচিত। এখানে বলে রাখা ভালো যে দেশের ৭৫টি জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
৫. দিল্লি সরকার ‘ওয়ো’-র সঙ্গে যৌথ ভাবে অনেকগুলো আইসোলেশন কেন্দ্র খুলেছে। পুরো দেশে এ ভাবে বেসরকারি ক্ষেত্রকে সঙ্গী বানিয়ে প্রচুর আইসোলেশন কেন্দ্র বানাতে হবে। এখানে মনে রাখা দরকার, যত বেশি আইসোলেশন কেন্দ্র খোলা হবে, ততই এই রোগকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে।
৬. আমাদের দেশে ডাক্তার এবং নার্সদের যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম নেই। এই পরিধানগুলো ডাক্তার এবং নার্সদের করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখে। ফলত ডাক্তার এবং নার্সরাও যে কোনও সময় আক্রান্ত হতে পারেন। তাতে, চিকিৎসা পরিষেবা আরও বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তাই খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসকদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম জোগাড় করতে হবে।
৭. সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে করোনাভাইরাসকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য। মানুষকে বিভ্রান্ত করার সব রকমের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিহারে কিছুদিন আগে একজন গোমুত্র পান করে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। তাই কুসংস্কার এবং মিথ্যে প্রচার রুখতে হবে এবং এই বিষয়েও সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। করোনাভাইরাস ধর্ম বা জাত বা ভাষা বা দেশ দেখে আক্রমণ করে না। তাই এখন আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে এবং মিথ্যে প্রচারকে অবহেলা করতে হবে।
৮. ভারতের অর্থনীতির অবস্থা করোনাভাইরাস আসার আগেও সঙ্গীন ছিল। করোনার করাল প্রকোপে সেই অর্থনীতির অবস্থা আরও সঙ্গীন। তাই নতুন করে ভাবার প্রয়োজন। শেয়ার বাজার দিনে দিনে আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। এই অবস্থায় একটি জোরদার অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। কেন্দ্র সরকারকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।
৯. সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে আমাদের। বাড়ির ভেতরে থাকা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এতে কিছুদিন অসুবিধে হলেও এটাই একমাত্র পন্থা এই রোগের বিস্তার রোখার। আমাদেরকে প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে যে মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে করোনাভাইরাসকে রোধ করা একান্ত কর্তব্য।
১০. যাঁরা বিদেশ থেকে ফিরে এসে নিজেদের আলাদা করে রাখছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ করতে হবে সরকারকে। কারও অধিকার নেই, অন্য মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার।
সব চাইতে বেশি প্রয়োজন আমাদের মনোবল বজায় রাখা। পৃথিবী আজ বিপদগ্রস্ত। তবে আমরাই পারি এই বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। চলুন এগিয়ে যাই এবং সরকারের প্রতিটি ইতিবাচক পদক্ষেপকে সমর্থন করি।