নতুন করোনাভাইরাসের গ্রাসে দুনিয়া। ধরিত্রীর জনপদ এখন পাণ্ডুর, হাসপাতাল থমথমে, পরিত্রাণ খুঁজতে গবেষণাগারগুলো চঞ্চল। বিদগ্ধ বিশেষজ্ঞের বিচিত্র পরামর্শে জনসমাজ দিশেহারাপ্রায় এবং প্রশ্নাতুর। ভাইরাসের ভাষা, ভূগোল আর ব্যাকরণ নিয়ে মুখর সংবাদমাধ্যম। ও দিকে মানুষ শুধু জনবিচ্ছিন্নই না, নিজের ঘরেই অন্তরীণ। অবশ্য মনোবিচ্ছিন্নতার অভ্যাস আমরা আগেই সেরে নিয়েছি; উন্নত, সুখী জীবনের বাসনাবিলাসে কবেই আমরা পরিবার ভেঙে ফেলেছি। এই বার এক উদ্ভট জীবাণু এসে যেন সব কিছু আরও ওলটপালট করে দিল; কী জানি, এই নতুন বিচ্ছিন্নতাই হয়তো কোনও নতুন সভ্যতার জন্ম দেবে।
নতুন সভ্যতা, সভ্যতার চতুর্থ ধাপ। দাস প্রথা আর সামন্ত প্রথা পেরিয়ে আমরা এখন রয়েছি সভ্যতার তৃতীয় ধাপে। এ হল আর্থিক আর রাজনীতিক একাধিপত্যের যুগ, যুদ্ধবাদের যুগ। আমরা বিশ্বাস করি, সব সমস্যার সমাধান আছে যুদ্ধে, সে গরিবি হোক বা সন্ত্রাসবাদ অথবা জীবাণু। এ হল বিজ্ঞানের যুগ। আমরা বিজ্ঞানমুখী এবং স্বার্থপর; তাই আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে আমরা যুদ্ধাস্ত্র চেয়েছি, সে দিয়েছে, আমাদের দর্পিত করেছে। বিজ্ঞানের কোনও মূল্যবোধ থাকে না, আমাদেরই তা থাকবার কথা। নেই; থাকলে বিজ্ঞানের কাছে যুদ্ধজ্ঞানের বদলে বোঝাপড়ার মন্ত্র চাইতাম, বিজ্ঞান তাও দিতে পারত। আমরা চাইনি, তাই দেয়নি।
দর্পের দাপটে আমরা এও ভুলেছি যে, যুদ্ধে কেউ জেতে না, সবাই হারে। গগনচুম্বী বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা আমাদের প্রাণী-হত্যা করতে শিখিয়েছে, অফুরন্ত, অনন্তর। শুধু হত্যা না, গবেষণাগারে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার। এ ছাড়া অন্য কোনও ভাবে আমরা আধুনিক, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালাতে শিখিনি। পরিণামে, জীববিজ্ঞানে যাদেরকে ‘প্রাইমেট’ বলে, তাদের সংখ্যা আগের তুলনায় এখন এক-দশমাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাদের শরীরে যাদের নিরাপদ ঘর-সংসার ছিল সেই ভাইরাসবর্গ এ বার যায় কোথায়? শুধু ‘নতুন’ করোনাই না, ইবোলা, এইচ আই ভি-এর মতো ভাইরাসগুলোর স্বচ্ছন্দ বসবাস তো পশুর ভুবনেই, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে। মনুষ্যশরীরে তাদের থাকবার কথা না।
তবুও তারা আমাদের শরীরই বেছে নেয়, কেননা আমরাও স্তন্যপায়ী; জীব বিবর্তন আর জিনচরিত্রের নিরিখে আমরা প্রায় তাদের আত্মীয়ের মতোই। আমরা নিজেদের যতই উন্নত, সভ্য ভাবি না কেন, ভাইরাস-এর কাছে কিন্তু আমরা শুধু একটা সুন্দর বাসস্থান মাত্র। তাই এক প্রাণী থেকে ভিন্নতর প্রাণীর দেহে জীবাণুর অমন পরিক্রমার কারণ শুধু বৈকালিক ভ্রমণপিপাসা নয়; আসলে বেঁচেবর্তে থাকার একমাত্র উপায়। এই সুদৃশ্য, নতুন বাসস্থান তাদের কাছে বেশ লোভনীয়; জীবননির্বাহের বিচিত্র সামগ্রী হয়তো বেশিই মিলবে। বিচিত্র পরিবেশে বেঁচে থাকার কৌশল শুধু আমরাই রপ্ত করিনি, বিবর্তনের সুবাদে জীবাণুও ‘প্রাকৃতিক ভাবে নির্বাচিত’; বয়সে আর অভিজ্ঞতায় আমাদের চেয়ে তারা বহু প্রাচীন, কূটবুদ্ধিতেও উন্নত।
তাই কেন তারা আমাদের ঘরে পরজীবীর মতো থাকবে, এই অভিমান অসঙ্গত। আমাদের দিক থেকে দেখলে তারা বিরক্তিকর উপসর্গের জন্ম দেয় ঠিকই; কিন্তু তাদের দিক থেকে ওই উপসর্গ তো আর কিছু না, তাদের আগমনী সমারোহ, বাসরঘণ্টা। প্রতিরোধ আমরা করবই, আজ হোক কাল হোক, ‘টিকা’ও মিলবে; কিন্তু এও মনে রাখতে হবে যে, তারা থাকে বলেই প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকে। যা অদৃশ্য, অধরা, তার বিরুদ্ধে ‘জনস্বাস্থ্য যুদ্ধ’ চলে না। তাই বোঝাপড়াটাই শিখে নিতে হবে। কারণ, কোটি কোটি বছরের পুরনো জীবাণুর রাজ্যে উপনিবেশ তৈরি করে মারণযজ্ঞ আমরাই শুরু করেছি। তাতে জীবাণুকূল বরং আরও প্রতিস্পর্ধী হয়েছে, আর আমরা হারিয়েছি জৈবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা।
আমাদের যুদ্ধাভিমানের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আছে আর এক বিপদ— উদরপূর্তির প্ররোচনা। এক দিকে আছে চিরায়ুষ্মান ক্ষুধার জ্বালা, অপর দিকে জিহ্বার অমলিন লালসা। ক্ষুধা নিয়ম মানে না; তাই পশু বা প্রাণী-হত্যায় বাছবিচারও মানে না। আর লালসার কোনও অজুহাত লাগে না; তার যুক্তি, যে কোনও পশু-পাখির শরীর যদি চেখেই না-দেখতে পারি, তবে আর উপভোগ কিসের? জীবন তো ভোগ, উপভোগ আর বিনোদনের ধারাপাত। কৃষিকাজ শিখেছি বটে; কিন্তু শাক-সব্জিতেই দিনাতিপাত করতে হলে আর গাছ থেকে আমরা নেমে এলাম কেন! মোক্ষম যুক্তি; তাই থরে থরে সাজানো, জ্যান্ত আর মৃত পশু-পাখিদের বাজার গমগম করে।
আমরা ভুলে যাই যে, সবচেয়ে মারক ব্যাধিগুলোর উৎস হল পশুসমাজ। ঘন জনবসতিই সংক্রামক জীবাণুগুলোর সবচেয়ে পছন্দ। এই পছন্দের ইতিহাস প্রায় এগারো হাজার বছরের, মানুষ যখন কৃষিসভ্যতা আর পশুপালনের যুগে পা রাখছে। তার পর থেকে মহামারি আমাদের ছাড়েনি— বসন্ত, টিবি, ফ্লু, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, হাম, কলেরা, মার্গ, সার্স, ইবোলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত যত মানুষ অস্ত্রাঘাতে মারা গেছে, তার অনেক বেশি মারা গেছে সংক্রামক রোগে। কলম্বাস থেকে আলেকজ়ান্ডার পর্যন্ত সময়ে, যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র তরবারি ছিল না, গুলিগোলাও না; ছিল অচেনা, অজানা জীবাণু। সে কথা জয়ী আর পরাজিত কেউই বুঝতে পারেনি।
তাই মহামারি নতুন না। ১৩৪৬ থেকে ১৩৫২ সালের মধ্যে প্লেগ রোগের মহামারি ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা গিয়েছিল দু’কোটি মানুষ। বসন্ত আর কলেরার গল্প তো পুরনো কাসুন্দি। মাত্র দু’বছর আগেও হাম রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এক লক্ষ চল্লিশ হাজার আর ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণে এগারো হাজার। এখনও প্রতি বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর সংখ্যা দশ লক্ষ, টিবিতে তিন লক্ষ। এক দিকে সয়ে যাচ্ছে, আবার অন্য দিকে নতুন নতুন সংক্রমণের উদয় ঘটছে, নতুন নতুন নামে। ‘করোনা’ও তেমন অপরিচিত ছিল না, তবে এই ‘নতুন’ করোনার প্রাদুর্ভাব আমরা টের পাইনি।
কেন পেলাম না? কারণ, একটা মহামারির পরে যখন জনজীবনে শান্তির সঙ্গে আসে স্বস্তিও। অণু-পরমাণুর জগৎ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ১৯২৭ সালে আর্থার এডিংটন জানিয়েছিলেন, ‘কালের তির’ কেবল সম্মুখবর্তী, তাকে পিছনে টানা যায় না। ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার তত্ত্বে নাকি এই সমস্যার সমাধান নেই। অণুজীবের জগতেও একই কথা; তাদের সংহারপর্ব কেবল সম্মুখে ধাবমান। আমরা মনে রাখতে পারতাম যে, ‘তীর সম্মুখগতি যাইবার নিমিত্তে পিছু হটে, সর্পও দংশন করিবার পূর্বে আপনাকে পিছন পানে টানিয়া লয়। ‘আজও যদি বুঝতে না-চাই তাহলে আমরা ‘আধুনিক, বিজ্ঞ’ মানুষ হলাম কিসে? ‘তৃতীয় সভ্যতা’ আমাদের বৈভব দিয়েছে, তার কালিমাও; বিজ্ঞতা দেয়নি।
আজকের ‘নতুন’ করোনা ভাইরাস-এর উৎপত্তি যে উহানের বাজার থেকেই, তা নিয়ে অনেক মহলে সংশয় থাকলেও তথ্য সে দিকেই ইঙ্গিত করে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে তারা পশুবাজার নিয়ন্ত্রণ করেনি, মুনাফার টানে। ঘিঞ্জি বস্তিগুলোকে বাসবোপযোগী করে তোলেনি, মুনাফা হারাবার ভয়ে। খাদ্য ছাড়াও পশুপাখির মূল্য অনেক, কিন্তু তাই বলে সতর্কতা শিকেয়? উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে, পশুসমাজ থেকে মানবসমাজে ব্যাধির স্বচ্ছন্দ চলাচল আর বিন্যাস যে কত সহজ সেই তথ্য তো পুরনো। তা হলে?
গুজব আর ত্রাসের নির্মাণ তারই ফল, উদ্ভট রাষ্ট্রবাণীও। আজকের আতঙ্করজনী নিশ্চয়ই কেটে যাবে, তবে যে আর্থিক ধস নেমে এসেছে, তা হয়তো আরও প্রলয়ঙ্কর হবে। যে অসাম্য তৃতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কীর্তি, তা আরও বাড়বে। মানতেই হবে, মানব প্রজাতি লক্ষ বছর ধরে ক্রমশ প্রগতির পথেই এগিয়ে যাবে, সে কথা সত্যি নয়। বরং কৃষি সভ্যতার সময় থেকে সামাজিক, আর্থিক, লিঙ্গ বৈষম্য সবি বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যাধির প্রকোপ; শান্তি আর স্বস্তিতে বেঁচে থাকবার যাবতীয় উপাদানগুলো ক্রমশ বিলীয়মান। আর এই অবসরে ‘নতুন’ ভাইরাস যেন আমাদের ঝুঁটি ধরে ‘সাম্য’ বানান শিখিয়ে দিল!
এখনও যদি আমরা যুদ্ধাভিমানী আর শিশ্নোদরপরায়ণ থাকি, তা হলে প্রকৃতি তার বাঁ হাতের একটা মৃদু ঝটকায় ধরিত্রীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরজীবী, এই মানব প্রজাতি আর তার সাধের সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। তার পর আসবে চতুর্থ সভ্যতা।