তাহাকে দেখিতে না পাইলে থামাইতে পারিবে না।— কথাটি বলিয়াছেন ব্রুস এলওয়ার্ড। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রবীণ বিশেষজ্ঞ। কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ যাবৎ দুইটি প্রধান অস্ত্র নির্দিষ্ট হইয়াছে। এক, মানুষে মানুষে শারীরিক সংস্পর্শ যথাসম্ভব কমানো। দুই, সংক্রমণের কোনও সম্ভাবনা থাকিলেই শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি যাচাই করিয়া দেখা, অর্থাৎ টেস্টিং বা পরীক্ষা। পরীক্ষার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য: সংক্রমিত ব্যক্তির যথাযথ চিকিৎসা এবং কেবল তাঁহাকে নহে, তাঁহার সংস্পর্শে আসা সমস্ত ব্যক্তিকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া অবশিষ্ট সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন রাখা, যাহাতে তাঁহাদের কারণে সংক্রমণ না বাড়ে। কিন্তু পরীক্ষার পরোক্ষ এবং বৃহত্তর লক্ষ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: যত বেশি পরীক্ষা করা হইবে, ভাইরাসের চরিত্র এবং তাহার গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা তত স্পষ্ট হইবে, তাহাকে প্রতিহত করিবার লড়াই তত জোরদার হইবে। এই সত্যই নিহিত রহিয়াছে বিশেষজ্ঞের উপরোক্ত মন্তব্যে: ইউ কান’ট স্টপ ইট, ইফ ইউ কান’ট সি ইট।
এমন গুরুতর পরীক্ষায় ভারত সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দেশের জনসংখ্যার মাপকাঠিতে সংক্রমণের প্রসার এখনও আপাতদৃষ্টিতে সীমিত। কিন্তু তাহা নিশ্চিন্ততা দেয় না। তাহার কারণ, দেশে সংক্রমণ সম্পর্কে পরীক্ষার মাত্রা এখনও অত্যন্ত কম। অতি সম্প্রতিও ভারতে গড়পড়তা প্রতি দশ লক্ষ অধিবাসী পিছু পরীক্ষার সংখ্যা ছিল বড়জোর ২৫। যে দেশটি প্রবল তৎপরতায় পরীক্ষা ও পরবর্তী বন্দোবস্ত করিয়া সংক্রমণকে চমকপ্রদ ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখিয়াছে, সেই দক্ষিণ কোরিয়ায় সংখ্যাটি ৬০০০-এর বেশি। ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাহারা এই ভাইরাসের মোকাবিলায় অকল্পনীয় ও অমার্জনীয় উপেক্ষা দেখাইয়াছে, তাহাদের ক্ষেত্রেও দশ লক্ষ অধিবাসী পিছু পরীক্ষার সংখ্যা ২০০০-এর কাছাকাছি। ভারত এই তালিকায় বহু পিছনে, ভাইরাস-স্পৃষ্ট দেশগুলির মধ্যে প্রায় নিঃসঙ্গ। এই ব্যর্থতা গভীর উদ্বেগের কারণ। ইহাতে পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়া বড় রকমের প্রশ্ন থাকিয়া যায়। এই সন্দেহ স্বাভাবিক হইয়া উঠে যে, অনেক সংক্রমিতের পরীক্ষাই হয় নাই। যেহেতু এই ভাইরাসটি অনেকের দেহেই দিনের পর দিন বিনা লক্ষণে বসিয়া থাকে, তাহার ফলে এই সন্দেহ আরও গভীর, আরও সঙ্গত। ফলে, পরীক্ষার অগোচরে অন্যের দেহে সংক্রমণের আশঙ্কাও বাড়িয়া চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে এমন ঘটিয়াছে, সহসা সংক্রমণের সংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটিয়াছে। ভারত যে এখনও আগ্নেয়গিরির শিখরে দাঁড়াইয়া নাই, তাহা কে বলিবে?
কেন এই ব্যর্থতা? সরকার সীমিত সামর্থ্য এবং আকস্মিক বিপদের চেনা দোহাই পাড়িতেছে। সত্য, সামর্থ্য অসীম নহে। সত্য, এই বিপদ এক বছরের নোটিস দিয়া আসে নাই। কিন্তু ইহাও কম সত্য নহে যে, ভারত প্রস্তুতির জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় পাইয়াছে। এবং, বিপদের গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারংবার কেন্দ্রীয় সরকারকে সাবধান করিয়াছে। কিন্তু যুদ্ধপ্রস্তুতির অত্যাবশ্যক সরঞ্জামগুলি সংগ্রহ ও বণ্টনে প্রয়োজনীয় তৎপরতা দেখা যায় নাই। বিপাকে পড়িয়া সরকার অধুনা ঈষৎ সচল, ‘টেস্টিং কিট’ সরবরাহে এবং বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রকে ভাইরাস যাচাইয়ের অনুমোদন দেওয়ায় গতি বাড়িয়াছে, কিন্তু অতি বিলম্বে। এখনও পরীক্ষার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বিপদের গুরুত্ব এবং নিজেদের অপ্রস্তুতি, দুই বিষয়ে সচেতন বলিয়াই সম্ভবত দিল্লীশ্বররা মানুষকে ঘরবন্দি রাখিয়া অবস্থা সামাল দিতে চাহিতেছেন। এই মুহূর্তে অন্য উপায়ও নাই। কিন্তু অবিলম্বে যদি পরীক্ষার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা আরও অনেক বাড়ানো না যায়, তাহা হইলে আশঙ্কা প্রবল যে— ঘরবন্দি কেবল সংক্রমণকে কিছু দিন ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে, শেষরক্ষা হইবে না।