Coronavirus

ঘরবন্দির ন্যায়-অন্যায়

যে কোনও সামাজিক নীতির পিছনে ন্যায়ের একটা লক্ষ্য থাকে। করোনার প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের ন্যায়ের মুল লক্ষ্য হল সংক্রমণ কমানো, প্রাণ বাঁচানো।

Advertisement

অশোক সরকার

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২০ ০২:২০
Share:

দুধ, ঘি, দই অত্যাবশ্যক পণ্য। ঘরবন্দির পর থেকে হায়দরাবাদের এক দুগ্ধজাত পণ্যনির্মাতা সংস্থার কর্তার ঘুম ছুটে গেছে— ৩৬০০ শ্রমিককে পাঁচটা রাজ্যে দশটা কারখানায় রোজ পৌঁছতে হবে। শতাধিক চিলিং সেন্টারে ৯২,০০০ গোয়ালা রোজ সকালে-বিকেলে দুধ পৌঁছে দেবে, দুধের সাড়ে তিনশোর বেশি ট্যাঙ্কারে সেই দুধ কারখানায় যাবে, সেখান থেকে দুধ, দই, ঘি তৈরি হয়ে পৌছবে বিক্রেতাদের কাছে। ছেচল্লিশ শতাংশ বিক্রেতা হল রাস্তার হকার। পুলিশ শ্রমিককে কাজে যেতে দিচ্ছে না, পাঁচ জায়গায় শ্রমিকেরা পুলিশের লাঠি খেয়েছে, ট্রাক ও ট্যাঙ্কারগুলি পাস পাওয়ার জন্য জেলা শাসকের অফিসে হত্যে দিয়ে বসে আছে, কর্মীরা চিলিং সেন্টারে দুধ নিয়ে আসতে পারছেন না, আর রাস্তার হকারদের পুলিশ তাড়া করেছে। অন্য দিকে চিলিং সেন্টারে, কারখানায় স্যানিটাইজ়ার, গ্লাভস, কারখানার ক্যান্টিনে রান্নার সামগ্রী, কর্মীদের কাছে বিশেষ আইডেন্টিটি কার্ড পৌঁছতে হবে। রাস্তায় ধাবাগুলি বন্ধ, তাই ট্রাকচালকদের জন্য খাবারের প্যাকেটের ব্যবস্থা করতে হবে।

Advertisement

যে কোনও অত্যাবশ্যক পণ্যের ক্ষেত্রেই এই দশা। এর পাশাপাশি রয়েছে কাজ হারানোর ছবি। বেঙ্গালুরু হল দেশের সবচেয়ে যুবা শহর, জনসংখ্যার গড় বয়স আঠাশ বছর। এই শহর হোম-ডেলিভারি নির্ভর— চা, দুধ, আনাজ, মাংস, ওষুধ, জামাকাপড়, জুতোপালিশ, চুল ছাঁটা, সবেরই হোম ডেলিভারি হয়। তার সঙ্গে রাঁধুনি, সিকিয়োরিটি গার্ড, বাড়ির কাজের লোক তো আছেনই। আছেন প্রায় দু’লক্ষ উবের-ওলা চালক, তার সঙ্গে আছেন এগারো লক্ষ কাপড়ের কারখানার শ্রমিক। এঁরা সবাই কর্মহীন, কারণ ঘর থেকে বেরোতে পারছেন না।

যে কোনও সামাজিক নীতির পিছনে ন্যায়ের একটা লক্ষ্য থাকে। করোনার প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের ন্যায়ের মুল লক্ষ্য হল সংক্রমণ কমানো, প্রাণ বাঁচানো। সেই যুক্তিতে ঘরবন্দি ভাল উপায় ঠিকই, কিন্তু ঘরবন্দি হয়ে থাকতে তারাই পারে, যাদের স্থির রোজগার আছে, সঞ্চয় আছে, ঘরে যথেষ্ট খাবার আছে। আমাদের দেশে প্রায় ৩০-৩৫ কোটি মানুষের তা নেই। ঘরবন্দির তিনটে কুফল আছে— এক, দেশের উৎপাদন কমে যাওয়া, সাধারণ মানুষের আয় ও চাকরির ক্ষতি। দুই, গরিবের অনাহার ও অর্থকষ্ট। গরিবের বড় অংশ দিন আনে দিন খায়, ঘরে বন্দি হলে তাদের খাবার জুটবে না। তিন, ভারতে গরিবের সংখ্যা বড্ড বেশি, প্রায় ষাট শতাংশ। অপুষ্টির ফলে তাঁদের শরীরে প্রতিরোধ-ক্ষমতা কম। রোজগার না থাকলে অপুষ্টি বাড়বে। সেটা জনস্বাস্থ্যের ন্যায়কেও আঘাত করবে। জনস্বাস্থ্যের ন্যায়ের সঙ্গে অর্থনীতির ও জীবিকার ন্যায়ের সংঘাত এখানেই। এই সংঘাত অবশ্যম্ভাবী এবং পৃথিবীর সব দেশেই তা ঘটছে। ভারতে অপুষ্টি বিপুল, তাই সঙ্কট এখানে তীব্র।

Advertisement

অতএব রোগ প্রতিরোধের উপায় (ঘরবন্দি, হাত ধোওয়া), আর সেই সঙ্গে অকারণ আতঙ্ক ও কুসংস্কার বন্ধ করা, এই দুইয়ের জন্য যেমন লাগাতার প্রচার দরকার, তেমনই পঞ্চাশোর্ধ্বদের পুষ্টি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক প্রচার চাই। কী করলে শরীরে প্রতিরোধশক্তি বাড়বে, তার প্রচার দরকার। সেই সঙ্গে দরকার খাদ্যের জোগানকে জোরদার করা, তার জন্য রেশন ব্যবস্থাকে জোরদার করা। পুষ্টি বাড়ানোর জন্য সেখানে ডালের পরিমাণ বাড়াতে হবে, রেশনের মধ্যে সাবানকে আনতে হবে, তার জন্য সাবানকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ঘোষণা করতে হবে। শহরে প্রায় ৩০-৪০ ভাগ মানুষ অভিবাসী। তাঁদের ফিরতে না দেওয়া, তাঁদের খাবার ও অর্থের জোগান দেওয়া। শহরে প্রচুর লঙ্গরখানা চাই।

লকডাউনের মারাত্মক পরিণতির কথা ভেবে অনেক ছোট দেশ, যেমন জর্ডন বা পাকিস্থান, সেই পথে হাঁটতে পারেনি। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিও পুরো ঘরবন্দি ঘোষণা করেনি। কাজেই ঘরবন্দি নিয়ে ভাবার দরকার আছে। ভাবতে হবে তিন ধরনের লোকের কথা— যাঁরা নিজের শহরে বা গ্রামেই কাজ করেন; যাঁরা ট্রেনে-বাসে রোজ অন্য কর্মস্থলে যাতায়াত করেন; আর, যাঁরা অভিবাসী। দেশের প্রায় ১৪ কোটি অভিবাসী মানুষকে যদি নিজেদের গ্রামে-দেশে ফিরতে হয়, তাতে রোগ ছড়ানোর ভয় থাকে। কাজেই প্রথম কৌশল হল আশ্বস্ত করা, ফিরতে না দেওয়া; আর তাঁদের খাদ্যসুরক্ষার ও অন্য খরচের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করা, এবং তা মানুষের কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, যাঁরা ট্রেনে বা বাসে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন, তাঁদের ঘরবন্দির জন্য প্রস্তুতির সময় দেওয়া। স্থানীয়দের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। অন্য দিকে, ঘরবন্দি করতে গেলে, আর অত্যাবশ্যক বস্তুর জোগান চালু রাখতে গেলে, সেই পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের জন্য উপযুক্ত যানবাহনের ব্যবস্থা, সরকারি দফতর আর ওয়ার্ড কমিটিগুলিকে দিয়ে তাঁদের আইডেন্টিটি-পাস চালু করা, দিনের মধ্যে কাজের সময় বেঁধে দেয়া দরকার। আমাদের পুলিশ ঘরবন্দি আর কারফিউয়ের তফাত জানে না— প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলেছিলেন জনতা কারফিউ, তাই পুলিশ মানুষ দেখলেই লাঠিপেটা করেছে— ঘরবন্দিতে তাদের কী কাজ, সেটা শেখানো দরকার।

এত কিছু করতে অনেক পরিশ্রম। তার চেয়ে অনেক সহজ কাঁসর-ঘণ্টা বাজানো। কিংবা মোমবাতি জ্বালানো। কিংবা দূরদর্শনে রামায়ণ দেখানো।

লোকেদের ঘরে ফেরার লম্বা মিছিল, ও কি দেখার বস্তু?

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন