প্রবন্ধ ১

যা খুশি করার নৈতিক অধিকার রাষ্ট্রের নেই

দৃ শ্যটা প্রতীকী। সামরিক জিপের বনেটের সামনে বাঁধা টায়ারের উপরে বসে সেই তরুণ। যুবকটির শরীরের ঊর্ধ্বাংশ জিপের সঙ্গে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। স্নিকার পরা পা দু’টি লম্বা করে সামনের দিকে ছড়ানো।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

দৃ শ্যটা প্রতীকী। সামরিক জিপের বনেটের সামনে বাঁধা টায়ারের উপরে বসে সেই তরুণ। যুবকটির শরীরের ঊর্ধ্বাংশ জিপের সঙ্গে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। স্নিকার পরা পা দু’টি লম্বা করে সামনের দিকে ছড়ানো। বুকের উপরে পিন দিয়ে সাদা কাগজে লেখা একটি বাক্য: ‘পাত্থরবাজকো য়হি হাল হোগা!’

Advertisement

৯ এপ্রিল শ্রীনগর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের দিন ফারুক আহমেদ দার নামে ওই যুবককে মানব-ঢাল হিসেবে জিপের সামনে বেঁধে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়েছিল রাষ্ট্রীয় রাইফলস। গোটা দেশে ভাইরাল হয়েছে সেই ভিডিয়ো।

যে গণতান্ত্রিক ভিত মজবুত রাখার জন্য নির্বাচনের এত ঢক্কানিনাদ, সেই গণতন্ত্রই তার এক নাগরিককে এ ভাবে গিনিপিগ বানানোর অধিকার দেয়!

Advertisement

বিস্ময়ের এতেই শেষ নয়। ফারুক দাবি করেছেন, তাঁকে এ ভাবে বেঁধে রেখে গ্রামের পর গ্রাম ঘোরানো হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় রাইফলস-এর দাবি, তারা ফারুককে ‘মাত্র’ ১০০ মিটার পথ এ ভাবে ঘুরিয়েছে! অর্থাৎ, ১০০ মিটার পথ এ ভাবে ঘোরালে কোনও দোষ নেই! কতটা পথ ঘোরালে তবে দোষী বলা যায়? রাষ্ট্র সে ব্যাপারে কোনও ‘নির্দেশিকা’ এখনও দেয়নি!

কাশ্মীরের বদগা‌ম জেলার চিল গ্রামের বাসিন্দা ফারুকের পেট চলে শাল তৈরি করে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের যুবক ফারুকের প্রতিবেশীরাও দাবি করেছেন, তিনি খুবই ভদ্র। জীবনে কখনও সেনাবাহিনীকে লক্ষ করে পাথর ছোড়েননি। কিন্তু তাতে কান দিলে কি প্রশাসনের চলে? অতএব, নির্বাচনের দিন চিল গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বোনের বাড়িতে অন্ত্যেষ্টির কাজে যাওয়ার পথে ৫৩ নম্বর রাষ্ট্রীয় রাইফলস-এর জওয়ানরা তাঁকে আটকায়। যেখানে আটকানো হয় সেখানে আদৌ পাথর ছোড়া হচ্ছিল না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। মজার কথা হল, যাঁকে ‘মানব-ঢাল’ বানানো হল, সেই ফারুক কিন্তু সাতসকালে তাঁর ভোটটি দিয়েই বোনের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলেন। এবং এমন এক প্রেক্ষাপটে তিনি ভোট দিতে গিয়েছিলেন যেখানে ভোট বয়কটের ডাক চলছে। যেখানে এই উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে সাকুল্যে ৭.১৪ শতাংশ। যা গত দু’দশকে এই কেন্দ্রে সর্বনিম্ন। কয়েকটি বুথে পুনর্নির্বাচনে ভোটদানের হার আরও করুণ। মাত্র ২ শতাংশ।

দিনভর জিপের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় দারকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরানো হয়। সন্ধ্যায় সেনা হেপাজত থেকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত অবস্থায় তাঁকে ছাড়িয়ে যখন বাড়িতে ফেরান তাঁর পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়েরা, তখন তাঁর বাঁ হাত ভাঙা। অভিযোগ, তাঁকে মারা হয়েছে এমন ভাবে যে বাইরে থেকে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। মারা হয়েছে বন্দুকের বাট ও লাঠি দিয়ে, ধাক্কা মারতে মারতে জলে ফেলে দেওয়ারও চেষ্টা হয়। তিনি কোনও মতে উঠে এলে আবার তাঁকে মারে জওয়ানেরা।

এত কাণ্ডের পরেও কিন্তু ফারুক, ফারুকের ভাই ও মা জানিয়েছিলেন, তাঁরা গরিব মানুষ। সেনার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ দায়ের করবেন না। কারণ, তাঁরা মনে করেন, অভিযোগ করে কোনও ফল মিলবে না, উপরন্তু তাঁদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। এমনটা ভাবাই উপত্যকায় স্বাভাবিক। কারণ, সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও কাশ্মীর পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ভূরি ভূরি। ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, খাতায়-কলমে গ্রেফতার করা না হলেও জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া, হাজার হাজার যুবকের স্রেফ গায়েব হয়ে যাওয়া— তালিকা অন্তহীন।

অবশ্য এই ভিডিয়ো ক্লিপ নিয়ে দেশজোড়া তুমুল বিতর্কের মুখে সেনাবাহিনীর ৫৩ নম্বর রাষ্ট্রীয় রাইফলস-এর বদগাম জেলা ইউনিটের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে রাজ্য পুলিশ। এসডিপিও এই ঘটনার তদন্ত করবেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইনের (আফস্পা) বলে বলীয়ান ভারতীয় সেনা এই ‘তদন্ত’-এ ভয় পাবে কি?

উপত্যকার মানবাধিকার সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল পিপল’স ট্রাইবুনাল ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড জাস্টিস ইন ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্টারড কাশ্মীর’ এবং ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ পেরেন্টস অফ ডিসঅ্যাপিয়ারড পারসনস’-এর তৈরি সাড়ে তিনশো পাতার ‘পারপিট্রেটরস’ শীর্ষক তদন্ত রিপোর্টে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে অনেক ঘটনাতেই অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় রাইফলস। প্রতিটি ঘটনাই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সরকারি নথি থেকে। কিন্তু তাতে কী এসে যায়? উপত্যকার ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করতে মরিয়া রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভুদের বিড়ম্বনায় ফেলতে পারে, এমন কোনও তদন্তই অন্তিমে পৌঁছয় না।

কাশ্মীর নাকি ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’! যদি তা-ই হয়, তা হলে নিজের দেশের নাগরিকের সঙ্গে দেশের সেনাবাহিনী এমন ব্যবহার করতে পারে? যদি ধরেও নিই, কাশ্মীরে যুদ্ধ চলছে, তা হলেও তো ফারুকের সঙ্গে যা হয়েছে সেটা জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধ! এ ধরনের আচরণ তো ইজরায়েল করে থাকে প্যালেস্তাইনে! তা নিয়ে বারে বারে দুনিয়াজোড়া নিন্দার ঝড় ওঠে। সেটা যদি যুদ্ধাপরাধ হয়ে থাকে, এটা নয় কেন?

কাশ্মীরি ছাত্রদের উপরে ‘দেশপ্রেমী’দের হামলা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির আবেদনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দাওয়াই, কাশ্মীরের সঙ্গে সব রাজ্যের মেলামেশা বাড়ুক। তাতে কাশ্মীরিদের মনে ভারতের মূল ধারার সঙ্গে আত্মীয়তা বাড়বে।

বিচ্ছিন্নতাবাদের শিকড় কারা গভীর থেকে গভীরতর করছে? পাথর হাতে উপত্যকার কিছু ‘বিপথগামী’ যুবক? হুরিয়ত নেতারা? সীমান্তপারের প্রতিবেশী রাষ্ট্র?

আর আমরা? জাতীয়তাবাদের ঢেউ উঠেছে সর্বত্র। ভিন্ন সুর শোনা গেলেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে! নীতি পুলিশের দল সংখ্যায় ভারী হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ফারুকের ভিডিয়োর সঙ্গেই ভাইরাল হয়েছে আর একটি ভিডিয়ো। সিআরপিএফের একটি দলকে ধাক্কা মারছে, উত্ত্যক্ত করছে কিছু কাশ্মীরি যুবক। ওই জওয়ানদের উদ্দেশে কটূক্তি বর্ষিত হচ্ছে। ওই ভিডিয়োর সঙ্গেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্টে লেখা, ‘এই ...বাচ্চাগুলোকে ভারতীয় সেনাদের আর কত দিন সহ্য করতে হবে। লাথ মেরে বার করে দিক তাদের, যারা ভারতে থেকে নিজেদের ভারতীয় মনে করে না।’ এই পোস্টের সমর্থনে ফেসবুকে জাতীয়তাবাদের নামে ‘দেশপ্রেম’-এর আরও বেশ কয়েকটি ঘুঁটে দেওয়া হয়েছে অশ্লীল গালিগালাজ সমেত।

কাকে বোঝাব— আম আদমি যা ভাবে, করে এবং যে ভাবে অবলীলায় যা খুশি বলতে পারে, তা রাষ্ট্রশক্তির করা মানায় না! তার অনেক বেশি দায়িত্ববান হওয়া প্রয়োজন। দেশের জন্য সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগের কথা মনে রেখেও, তাদের এতটুকু অসম্মান না করেও বলা প্রয়োজন, তারা আধুনিক অস্ত্রে বলীয়ান এবং কাশ্মীর, মণিপুরের মতো অনেক জায়গাতেই বিশেষ আইনের সুবিধাভোগী।

‘দেশপ্রেম’-এর জোয়ারে শুধু যে ফারুকরাই ভেসে যাচ্ছেন তা নয়, বিরুদ্ধ স্বর রুদ্ধ করতে গিয়ে গোটা গণতন্ত্রই যে ঝিলমের জলে ভেসে যাচ্ছে, তার খেয়াল কে রাখে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন