প্রবন্ধ ১

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি তবে উত্তরণের পথ দেখাতে ব্যর্থ

এক ঝটকায় ফিরে এসেছিল ২৯ জানুয়ারি, ১৯৮৯। সে দিনও উদ্বিগ্ন ছাত্রছাত্রীরা ছুটে গিয়েছিল। গোরখ পান্ডে— দর্শনের কৃতী গবেষক, বাম ঘরানার অগ্রণী কবি, লেখক।

Advertisement

অভিজিৎ কুন্ডু

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

দিশা: শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার দাবিতে এনএসইউআই-এর সদস্য ও অনুগামীদের মশাল মিছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

এক ঝটকায় ফিরে এসেছিল ২৯ জানুয়ারি, ১৯৮৯। সে দিনও উদ্বিগ্ন ছাত্রছাত্রীরা ছুটে গিয়েছিল। গোরখ পান্ডে— দর্শনের কৃতী গবেষক, বাম ঘরানার অগ্রণী কবি, লেখক। সিলিং থেকে গামছায় ‘মুক্তি’ খুঁজে নিয়েছিল ভোজপুরী সংস্কৃতির অন্যতম স্বর। ক্ষুরধার ব্যঙ্গে যিনি ফালাফালা করে দিতে পারতেন— ‘সমাজবাদ বাবুয়া ধীরে ধীরে আয়ে...’ সকলে নয়, সকল বামপন্থীরাও নয়, শুধু কিছু বাম-গণতান্ত্রিক মনস্ক মানুষরা, সে দিন লিফলেট লিখেছিলেন, ‘বিকারগ্রস্ত এই সমাজে সুস্থ থাকাটাও এক ধরনের উন্মাদের লক্ষণ’। ক্যাম্পাসে সে রাতে একটা পাবলিক মিটিং হয়েছিল। ব্যস, এইটুকুই।

Advertisement

গত ১৩ মার্চ, ২০১৭, জওহরলাল নেহরু ক্যাম্পাস আলোড়িত হয়েছে এমনই এক নিদারুণ খবরে। মুথুকৃষ্ণণ তামিলনাড়ুর দলিত ছাত্র। গত বারই ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। তাঁর আত্মহননের ঘটনায় আছড়ে পড়েছে নানা স্বরে প্রতিবাদ আর আশঙ্কা। স্রেফ স্মরণসভার মধ্যে আটকে না থেকে বৃহত্তর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতেই সকলে ধরতে চাইছে এই দুঃখজনক ঘটনাকে। হাতিয়ার নানাবিধ সামাজিক মাধ্যম।

মনীষা মশাল। দলিত আন্দোলনের অগ্রণী বক্তা-শিল্পী, তাঁর বেড়ে ওঠার ঘাতপ্রতিঘাতের কথা বলতে গিয়ে টেনে এনেছেন সেই ছোট ছোট আপাত ‘স্বাভাবিক’ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাকে। হরিয়ানার প্রত্যন্ত জিন্দ জেলার এক দলিত কন্যার ঘরদোরের যে উচ্চবর্ণ জমির মালিকের সঙ্গে বিষম সম্পর্ক, তাঁদেরই সন্তানদের সঙ্গে একই স্কুলকলেজে পড়ার অভিজ্ঞতা। শিক্ষকশিক্ষিকা থেকে সহপাঠী, সকলের কাছে মনীষা নামের বদলে ‘চুড়ে’ (নিম্নবর্ণ বাল্মীকি) পরিচয় বা সেকুলার ‘রিজার্ভেশনওয়ালি’ বা ‘লেট অ্যাডমিশনওয়ালি’ ডাকের বোঝা তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়। এমন কাঁটায় ভরা পথ পেরিয়ে মনীষা-ভাষ্য কিন্তু ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি নিম্নবর্ণের কোনও স্বর হয় না? মনীষা মশাল বর্তমানে অল ইন্ডিয়া দলিত উওম্যান রাইটস ফোরাম, হরিয়ানা-র রাজ্য সংগঠক।

Advertisement

কী অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছে রোহিত ভেমুলা, মুথুকৃষ্ণণ বা মনীষা মশালদের আশঙ্কা-জর্জরিত প্রকাশ্য অভিব্যক্তি। ভেমুলা লিখেছিলেন, আমরা এক এক জন পরিণত হচ্ছি আমাদের তাৎকালিক পরিচয় বা সত্তাতে। মুথুকৃষ্ণণ লিখে রাখলেন, সমতার অভাবের অর্থই হল বঞ্চনা। মনীষা বলতে চাইছেন, নিম্নবর্গের অভিজ্ঞতা এলিট প্রতিষ্ঠানের আলোকপ্রাপ্ত অবভাসে বোঝা যাবে না।

ব্লগ লিখতেন মুথুকৃষ্ণণ। নয়া সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্তে আমরা পড়তে পারছি মুথুকৃষ্ণণের জীবন অভিজ্ঞতা। ভেমুলার সহযোদ্ধা লিখেছেন, ‘পুরাণের কল্পিত চরিত্রকে পরিহাস করার জন্য গ্রেফতার হতে হচ্ছে নিম্নবর্গের বুদ্ধিজীবীদের। এঁরা বিরুদ্ধাচরণ করলেই দাগিয়ে দেওয়া আছে দেশদ্রোহী বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার স্ট্যাম্প।... তবু আমরাই কিন্তু এ দেশের, এই মাটির প্রকৃত সম্তান। আমাদের মেরে ফেললে, এ দেশও থাকবে না।’

বর্ণ-ধর্ম-জাতিসত্তার ভিত্তিতে বৈষম্য ও পার্থক্যকরণ যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয় পেয়ে বসবে, তা কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের সময় ভাবা যায়নি। বৈষম্য অনুভবের এমন চরমতম পরিণাম কোনও ব্যতিক্রমী বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৮ সালে সেনথিল কুমার, ২০১৪-য় পি রাজু আর মাদারি ভেঙ্কটেশ একই ভাবে বেছে নিয়েছেন নিঃশব্দ ‘প্রতিবাদ’, ‘আত্মসমর্পণ’।

যে অস্থির সমাজচিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন মুথুকৃষ্ণণ তাঁর লেখনীতে, সেই অস্থিরতাই হয়তো ধারণ করে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন তিনি। ভেমুলার সহযোদ্ধার এই আত্মহনন কি কোনও ছোঁয়াচের ফল? সাইকোপ্যাথোলজির বিশ্লেষণে হয়তো ঢাকা পড়ে যাবে এক বিশ্বাসভঙ্গের আখ্যান। হারিয়ে যেতে পারে সেই অস্থিরতার সূত্রসন্ধান।

খুব সহজে, প্রথমেই মেনে নিতে হবে সার্বিক অসহিষ্ণুতার আর আশঙ্কার একটা বয়ান তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে আধুনিকতার মডেলে বিবাদ-বিতর্কের এক পরিসরও ভাবা হয়েছিল। সেই পরিসরে প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক ধারাও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিল। সেই জনপ্রিয় ধারার এখন উল্টো স্রোত। পেশিশক্তি সম্বলিত, আগ্রাসী শিক্ষা-জ্ঞান-বিরোধী এক সামাজিক স্রোত ‘নয়া ভারতবর্ষ’ গড়তে উদ্যোগী। গণতান্ত্রিক পরিসরের সঙ্কুচিত হয়ে ওঠার হা-হুতাশ পেরিয়ে আমরা অন্য ভাবেও বোঝার চেষ্টা করতে পারি এই চালচিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি এ যাবৎ সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন থেকে আমাদের উত্তরণের পথ দেখাতে ব্যর্থ? আশু সামাজিক সমাধান আর মানবিক-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, এই দুইয়ের মধ্যে কি বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে গত সাত দশকে?

উনিশ শতকে গোড়ায় আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য গড়ে দিয়েছিলেন জার্মান চিন্তাবিদ উইলহেল্ম ভন হামবোল্ট। জ্ঞানার্জনের স্বাধীনতার সুযোগে যুক্তি-নিষ্ঠার উপর দাঁড়িয়ে এক এক জন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে বিশ্বনাগরিক। কর্তৃত্ববাদ, অসাড় ঐতিহ্য আর গোঁড়ামির বদলে যুক্তিবিদ্যা, ন্যায়পরায়ণতা, অভিজ্ঞতাবাদের ধারক হয়ে উঠবে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় একই মডেলে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গড়ে উঠতে চেয়েছিল। অভিজাত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এর অভিমুখগুলো ছিল গণমুখী। চার পাশের সামাজিক চালচিত্রে যেখানে গোঁড়া আদি পরিচয়ের বাড়বাড়ন্ত, তার মধ্যেই আধুনিকতার বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আকর্ষণ করেছে সামাজিক সচল অংশকে।

আধুনিকতার মূল শর্ত হল একে অপরের পরিপূরক আত্মনিষ্ঠা। নিজেদের আদি পরিচয়-সত্তা সরিয়ে রেখে আমরা কি পেরেছি একে অপরকে বুঝতে? এই ‘আধুনিক দ্বীপপুঞ্জে’ বসে পাশের উচ্চবর্ণের সহপাঠীকে সামাজিক সুবিধাভোগী হিসেবেই দেখেছি বা নিম্নবর্গের ছাত্রীটিকে ভেবেছি ‘সংরক্ষণ ব্যবস্থা’র উৎপন্ন জীব। নিজ নিজ জীবনবোধ উপজাত হিসেবে একে অপরকে মেনে নেওয়া— সে সব যেন অধরাই থেকে গেল।

এই শতাব্দীর গোড়ায় আমরা পরিচিত হচ্ছিলাম জ্ঞানভিত্তিক নলেজ সোসাইটির প্রতিশ্রুতিতে। জ্ঞানকেন্দ্রের পীঠস্থান থেকেই সেই জ্ঞান বিচ্ছুরণ হওয়ার কথা। কিন্তু সমাজে বিস্তৃত রয়েছে গোষ্ঠীভিত্তিক অসংখ্য সাবেক মাইক্রো‘জ্ঞান’ কেন্দ্রগুলো। এই দুইয়ের মধ্য সুরসঙ্গম হল না, উল্টে উত্তরোত্তর বেড়ে উঠল অবিশ্বাস। পালাবদলে উল্টো শ্রোতে বইছে ‘জ্ঞান-বিচ্ছুরণ’। গুলিয়ে দেওয়ার প্রত্যক্ষ কিছু সুবিধে আছে। অথবা, এ-ও কি এক মলম? আগ্রাসী বাজার জর্জরিত জনজীবনের এক নিরাপদ সাংস্কৃতিক অব্যাহতি।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন