মানুষ বাঁচিবে কি

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ বিকাশ রাওয়াল কিছু কাল পূর্বে একেবারে টাকার অঙ্কে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়াছিলেন। অন্যান্য বহু অর্থনীতিবিদও তাঁহার সহিত ভিন্নমত হন নাই। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রকের প্রকাশিত আর্থিক সমীক্ষাও সেই কথাই বলিল— গরু জবাই বন্ধ করিয়া দিলে চাষির পক্ষে তাহার অর্থনৈতিক ফল মারাত্মক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৭ ০০:৪৬
Share:

গরু বাঁচিলে মানুষ বাঁচিবে কি? মহম্মদ আখলাক বা জুনেইদ খানদের কথা স্মরণে রাখিলে এই প্রশ্নের আর উত্তর খুঁজিতে হয় না। কিন্তু, যাঁহারা মুসলমান নহেন, গোমাংসে যাঁহাদের রুচি নাই, অর্থাৎ গোরক্ষাবাহিনী সচরাচর যাঁহাদের উপর লাঠিসোঁটা হাতে ঝাঁপাইয়া পড়ে না, তাঁহাদের জীবনও কি গরুর জীবনের সহিত ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে জড়াইয়া গিয়াছে? ইদানীং নরেন্দ্র মোদীর মুখে যাঁহাদের কথা ঘুরিয়াফিরিয়াই আসে, গোরক্ষার জিগির কি সেই গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারগুলির পক্ষে মারাত্মক হইতেছে? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ বিকাশ রাওয়াল কিছু কাল পূর্বে একেবারে টাকার অঙ্কে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়াছিলেন। অন্যান্য বহু অর্থনীতিবিদও তাঁহার সহিত ভিন্নমত হন নাই। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রকের প্রকাশিত আর্থিক সমীক্ষাও সেই কথাই বলিল— গরু জবাই বন্ধ করিয়া দিলে চাষির পক্ষে তাহার অর্থনৈতিক ফল মারাত্মক। গোহত্যা বন্ধ করিবার সমর্থনে যুক্তি সাজিতে প্রধানমন্ত্রী মহাত্মা গাঁধীর প্রসঙ্গ টানিয়া আনেন। হরেক অপব্যাখ্যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘুণাক্ষরেও যে কথাটি উল্লেখ করেন না, তাহা হইল, গোহত্যা নিবারণের প্রসঙ্গে গাঁধী নিজের অবস্থান বহুলাংশে বদলাইয়াছিলেন। এবং, তাহার পিছনে ছিল অর্থনীতির যুক্তি। গাঁধী স্বয়ং স্বীকার করিয়াছিলেন, গোহত্যা বন্ধ করিবার আর্থিক দিকটি তিনি ভাবিয়া দেখেন নাই। তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যায়, নরেন্দ্র মোদীরাও ভুল করিয়াছেন। কিন্তু, গরিব মানুষের উপর নিজেদের (রাজনৈতিক) অবস্থানের নেতিবাচক প্রভাব বুঝিয়া নিজের ভুল স্বীকার করিয়া লইতে যে সততা এবং মানসিক জোরের প্রয়োজন, তাহা সুলভ নহে।

Advertisement

সমস্যাটি অতি স্পষ্ট। যে গরু দুধ দেয় না, কৃষকের নিকট তাহা নিখাদ বোঝা। তাহাকে রাখিতে জায়গা লাগে, তাহার খাদ্যের সংস্থান করিতে হয়। রাষ্ট্রীয় ডান্ডার ভয়ে তেমন গরুও যদি পুষিতে হয়, তবে নিজের পেট কাটিয়া গরুকে খাওয়ানো ভিন্ন কৃষকের আর উপায় থাকে না। যে গরু বিক্রয় করিয়া ঘরে কিছু টাকা আসিত, এখন তাহার জন্য আরও গুনাগার দিতে হইবে। কৃষকের সম্মুখে, অতএব, দুইটি রাস্তা খোলা। এক, মুখ বুজিয়া এই ক্ষতি সহ্য করিয়া চলা; অথবা দুই, গরু পোষা বন্ধ করিয়া দেওয়া। অনুমান করা চলে, কৃষকরা দ্বিতীয় রাস্তাটিই বাছিতে চাহিবেন। তাহাতেও আর্থিক ক্ষতি বিলক্ষণ— গবাদি পশু পালন করা গ্রামীণ অর্থনীতির একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। কিন্তু, গরু পোষা বন্ধ করিতে চাহিলেই তাহা করা সম্ভব নহে। হাতে থাকা গরুগুলি বিদায় করিবার রাস্তা নাই। অতএব, নেতাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূল্য গরিব মানুষ চুকাইবেন।

প্রশ্ন হইল, এমন একটি সমস্যার কথা নরেন্দ্র মোদীদের চোখ এড়াইয়া গেল কী ভাবে? অনুমান করা চলে, আসলে তাঁহারা দেখিতে চাহেন নাই। তাঁহাদের নিকট এই মুখগুলি ভোটব্যাংকমাত্র, রক্তমাংসের মানুষ নহেন। ‘মন কি বাত’-এ যতই গরিবের কথা থাকুক, মনে তাঁহাদের ঠাঁই নাই। ফলে, নেতারা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সুফলের হিসাব কষিয়াছেন, তাহার অর্থনৈতিক প্রভাবের কথা ভাবেন নাই। ঠিক যেমন, নোটবদলের খেলায় মাতিবার পূর্বে নরেন্দ্র মোদী ভাবেন নাই, অসংগঠিত ক্ষেত্রে ঠিকা শ্রমিকের জীবনের উপর এই নীতি কী প্রভাব ফেলিবে। সেই ভাবনার দায় তাঁহার— তাঁহাদের— নাই। তিনি ‘করিবেন, এবং করিয়াই ছাড়িবেন’। যাহারা মরিয়াই আছে, তাহাদের না হয় আরও এক বার মরিতে হইবে। যে দুই নেতার সহিত নরেন্দ্র মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা— যাঁহাদের মধ্যে এক জনের তিনি অনুকরণ করেন, আর অন্য জনকে মুিছয়া ফেলিতে চাহেন— সেই মহাত্মা গাঁধী ও জওহরলাল নেহরুর সহিত তাঁহার ফারাক কোথায়, তাহা বোধ করি আর দেখাইয়া দিতে হয় না।

Advertisement

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন