বিশ্বকাপ ফুটবল লইয়া উৎসাহী হইবার কারণ আছে। না, অদূর ভবিষ্যতে ভারত এই প্রতিযোগিতার চৌহদ্দিতে পা রাখিবে, তেমন সম্ভাবনা নাই। ভারতীয় ফুটবলের মান ইদানীং কিঞ্চিৎ উন্নতির পথে হাঁটিতেছে বলিয়া সন্দেহ হয়, তবে আন্তর্জাতিক ফুটবল অন্য গ্রহের ব্যাপার। তথাপি ফুটবল বিশ্বকাপ ভারতের পক্ষেও প্রাসঙ্গিক। বস্তুত, সমগ্র বিশ্বের পক্ষেই। বিশ্বকাপ ফুটবলের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সহিত জড়িত রহিয়াছে গণতন্ত্রের, এবং বাজার অর্থনীতির জয়যাত্রার ইতিহাস। বস্তুত, আধুনিক বিশ্বকাপের ময়দানে শুধু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই জয়যাত্রা। প্রসঙ্গত, মহিলাদের ফুটবল বিশ্বকাপেও প্রতি বারই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জয় হইয়াছে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি ও নরওয়ের দল এই প্রতিযোগিতা জিতিয়াছে। চিন এক বার ফাইনালে পৌঁছাইয়াছিল, সেই অবধিই। লক্ষণীয়, অন্যান্য খেলায়, বিশেষত অ্যাথলেটিক্স-এ, রাশিয়া বা চিনের ন্যায় দেশের জয়পতাকা দুর্নিবার। অলিম্পিকস-এর পদকতালিকা দেখিলে ভ্রম হইতে পারে, ইহা বুঝি প্রধানত অগণতান্ত্রিক দেশেরই প্রতিযোগিতা। কিন্তু, ফুটবল ভিন্ন গল্প।
পরিসংখ্যান বস্তুটি অবশ্য চিরকালই গোলমেলে। পুরুষদের চুলের গড় দৈর্ঘ্যের সহিত দেশে অগভীর নলকূপের সংখ্যার কো-রিলেশন বা অনুবন্ধও কেহ হিসাব কষিয়া বাহির করিতে পারেন, এবং বলা যায় না, হয়তো সম্পর্কটি পরিসংখ্যানগত ভাবে তাৎপর্যপূর্ণও হইবে। কিন্তু, সংখ্যাতত্ত্বের সেই হিসাব কিছুই বলে না। অতএব, অনুবন্ধ থাকিলেই হইবে না, তাহার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে কি না, তাহা বিচার করা জরুরি। ফুটবল বিশ্বকাপে জয়লাভ আর দেশে গণতান্ত্রিক সরকার থাকিবার মধ্যে যে অনুবন্ধ, তাহাও কি শুধু সংখ্যাতত্ত্বের খেল? না, এই ক্ষেত্রে যুক্তি অতি মজবুত। প্রথম যুক্তির নাম, গণতান্ত্রিক অভ্যাস। চিনের ন্যায় দেশ মানুষকে রোবটে পরিণত করিতে পারে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় নজরদারি আর ছক বাঁধা অনুশীলনে রোবট নির্মিত হইবে। সেই রোবট একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করিবে ধারাবাহিক ভাবে, এক লাফে টপকাইবে নির্দিষ্ট উচ্চতা, কিন্তু এই বাঁধা গতে সৃষ্টিশীলতা জন্মে না। ফুটবলে সেই সৃষ্টিশীলতা, নিজে ভাবিবার ক্ষমতার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাবিবার ক্ষমতাকে মারিয়াই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। হাজার শৃঙ্খলাতেও তাহাকে ফিরিয়া পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় যুক্তিটি বাজারের। যে দেশগুলি খোলা বাজারে বিশ্বাসী, যাহাদের নিকট জাতীয়তাবাদের গরিমা অপেক্ষা বাজারের মাহাত্ম্য অধিক, তাহারা দলের কোচ খুঁজিবার জন্য গোটা দুনিয়া চষিয়া ফেলে। বিদেশি বা ভিনদেশে প্রতিষ্ঠিত দেশীয় প্রশিক্ষকে তাহাদের আপত্তি নাই মোটে। খেলোয়াড় চিনিতেও বাজারই ভরসা। শৈশবেই যাঁহাদের প্রতিভার প্রমাণ মিলে, তাঁহারা তো বটেই, যাঁহারা বিলম্বে বিকশিত হন, তাঁহারাও বাজারের নজর এড়ান না। দেশের খেলোয়াড়রা নির্দ্বিধায় বিদেশের, বিশেষত ইউরোপের, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লিগে খেলিতে যান। এবং, সেই আগুনে পুড়িয়াই খাঁটি সোনার হদিস মিলে। অতএব, যাঁহারা গণতন্ত্রের পূজারি, যাঁহারা বাজারের মাহাত্ম্যে বিশ্বাসী, বিশ্বকাপ ফুটবল তাঁহাদের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ। বাজার কেন জয়ী হয়, তাহা আরও এক বার বলিবার জন্য।