দুর্গতদের গায়ে ‘জঙ্গি’ তকমা এঁটে দিয়ে গণতন্ত্র চালানো যায় না

সু চি, আপনি পারলেন না

মায়ানমার সরকার বলবে, এই তাণ্ডব তো সন্ত্রাসবাদী রোহিঙ্গারাই শুরু করেছে! ২৫ অগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের একটি জঙ্গি দলের হানায় প্রাণ হারায় বেশ কিছু পুলিশকর্মী। এবং তার পর থেকেই শুরু হয় সামরিক প্রত্যাঘাত। কিন্তু প্রশ্ন হল, একটা জঙ্গি বাহিনীর কিছু লোকের হিংস্র আক্রমণের জন্য কেন একটা গোটা সম্প্রদায়কে জঙ্গি বলে দেগে দেওয়া হবে?

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:১০
Share:

‘জঙ্গি’: প্রাণ রক্ষার মরিয়া চেষ্টায় সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের পথে বহু রোহিঙ্গা পরিবারের একটি। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭। ছবি: রয়টার্স

মায়ানমারের দুর্গত রোহিঙ্গারা আপাতত সব্বাই ‘টেররিস্ট’, অন্তত মায়ানমার সরকারের কথা শুনলে তেমনটাই মনে হয়। আমাদের দেশের শাসকরাও হরেদরে সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করছেন! কিন্তু ১১ লাখ মানুষ সদলবলে একসঙ্গে জঙ্গি হয়ে গেল? এটা বেশ অদ্ভুত না? আর কেমন আছে সেই জঙ্গিরা? মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে, রোহিঙ্গাদের বাস যেখানে, গত ২৫ অগস্ট থেকে ফের শুরু হয়েছে তাণ্ডব। যাকে বলে কচুকাটা, তা-ই চলছে। বুড়ো, জোয়ান, মহিলা, ছয় বছরের বাচ্চা— কেউ বাদ পড়ছে না। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে প্রচারিত উপগ্রহ-চিত্রে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ এলাকা এবং মানুষ আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এবং অন্যান্য সংস্থার খাবারদাবার, ওষুধ ও অনুদান ঢোকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পক্ষকালের মধ্যে প্রায় পৌনে তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মায়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য জায়গায় আস্তানা খুঁজছেন—আপাতত এটাই রাষ্ট্রপুঞ্জের শেষ হিসেব। এরা সবাই টেররিস্ট? এই বাচ্চা, বুড়ো, জোয়ান, মহিলা, সব্বাই? সব রোহিঙ্গা?

Advertisement

মায়ানমার সরকার বলবে, এই তাণ্ডব তো সন্ত্রাসবাদী রোহিঙ্গারাই শুরু করেছে! ২৫ অগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের একটি জঙ্গি দলের হানায় প্রাণ হারায় বেশ কিছু পুলিশকর্মী। এবং তার পর থেকেই শুরু হয় সামরিক প্রত্যাঘাত। কিন্তু প্রশ্ন হল, একটা জঙ্গি বাহিনীর কিছু লোকের হিংস্র আক্রমণের জন্য কেন একটা গোটা সম্প্রদায়কে জঙ্গি বলে দেগে দেওয়া হবে?

মায়ানমার সরকার আরও বলবে: রোহিঙ্গাদের তো সে দেশে কোনও নাগরিকত্বই নেই, ১৯৮২ সালেই আইন করে সেটা নাকচ করা হয়েছে। তাদের রোহিঙ্গা নামটিও মানে না মায়ামনার সরকার, তাদের বলে ‘বাঙালি’। বাংলাদেশ থেকে আসা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। ও দিকে বাংলাদেশ বলে, ওরা আমাদের নাগরিক নয়, মায়ানমার থেকে এ দেশে পালিয়ে এসেছে। আর এখন ভারত সরকারও বলছে, এ দেশে চল্লিশ হাজার শরণার্থী রোহিঙ্গা বেআইনি ভাবে বাস করছে, তাদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাতে হবে। তার মানে, দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আছে, কিন্তু নেই। কোত্থাও নেই। আর যারা ‘নেই’, তাদের তো মানবাধিকারও নেই। রাষ্ট্রের চোখে তারা— ভ্যানিশ!

Advertisement

অথচ মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় মসনদে এখন মানবাধিকারের মসিহা। নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখন জানা ছিল না যে তাঁর মানবাধিকারের লড়াই সকলের জন্য নয়। ক্ষমতা হাতে পেয়েও আউং সান সু চি রোহিঙ্গাদের সংকট এড়িয়ে গেলেন। বললেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদি থেকেও থাকে, তিনি কেন সেই প্রশ্নের একটা মানবিক এবং নৈতিক মীমাংসার চেষ্টা করলেন না? তিনি কেন একটি সত্যিকারের সর্বজনীন নীতি তৈরি করার ধক দেখাতে পারলেন না, যা সবাইকে নিয়ে চলতে পারে?

শেষ পর্যন্ত অবশ্য আন্তর্জাতিক চাপেই সু চি ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূতপূর্ব মহাসচিব কোফি আন্নান-এর ফাউন্ডেশনকে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি বিষয়ে সমীক্ষার দায়িত্ব দেন। সম্প্রতি তারা রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টে লেখা আছে, রোহিঙ্গাদের কী প্রয়োজন, তাঁরা কেমন আছেন, তাঁদের মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য কী করণীয়। রিপোর্টটি কিন্তু একপেশে নয়, সেখানে স্পষ্ট বলা রয়েছে, বর্তমান যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সরকারের পক্ষে হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। এবং রোহিঙ্গাদের জন্য যা যা করণীয় তা এই পরিস্থিতিতে বাস্তবায়িত করা কঠিনও বটে। তবে, যত কঠিনই হোক, সমস্যার মোকাবিলা করা জরুরি, না হলে পরিস্থিতি আরওই হাতের বাইরে চলে যাবে। রোহিঙ্গাদের প্রতি এক দিকে সরকারের দীর্ঘ ঔদাসীন্য, ঠিকঠাক নীতি ও পরিকাঠামোর অভাব এবং অন্য দিকে এই উগ্র সামরিক তৎপরতা পরিস্থিতিকে ক্রমশই করে তুলছে সঙ্গিন, আরও হিংসা আর নিদারুণ প্রতিক্রিয়াকে হাজির করে চলেছে অনবরত, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে যাঁরা তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণের যুক্তি খাড়া করছেন তাঁরা কোফি আন্নান কমিটির এই বক্তব্যটি মন দিয়ে শুনলে ভাল করবেন। সোজা কথা হল, এত মার খেলে একটা সময় মার-খাওয়া লোক এক সময় না এক সময় তো মারবেই। উগ্রবাদী হয়ে উঠবেই। শরীর-আত্মাকে এমন অত্যাচার, অপমান আর অবমাননা দিনের পর দিন সহ্য করতে হয়েছে, তার পরেও কেন আরও বহু রোহিঙ্গা জঙ্গি হয়ে যায়নি, সেটাই তো বরং বিস্ময়ের! বাস্তুহারা দেশহারা পরিচয়হারা সহায়হীন সম্বলহীন মরিয়া মানুষের পিঠ যখন একেবারে শেষ দেওয়ালে ঠেকে যায়, তখন জঙ্গি আগ্রাসনই হয়ে ওঠে তার একমাত্র অবলম্বন। আর এই জঙ্গি আগুনকে হাওয়া দেয় রাষ্ট্রের মার। যে সরু ফাটল ধরে জঙ্গিগিরি শুরু হয়, সেটি বড় হতে সাহায্য করে নিপীড়ন, অত্যাচার। এগিয়ে আসে বিদেশি শক্তশালী জঙ্গিগোষ্ঠীর সাহায্যের হাত। যেমন, মায়ানমারে আরাকান স্যালভেশন আর্মির হাত নাকি ধরেছে লস্কর-এ-তইবা। এই সন্ত্রাসের কঠোর মোকাবিলা নিশ্চয়ই দরকার, কিন্তু যারা জঙ্গি হয়ে উঠছে, তাদের প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রকেই একটি বৃহৎ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু মায়ানমার সরকার তা শুনতে রাজি নয়।

শুনতে রাজি নয় ভারত সরকারও। এই উত্তাল সময়েই ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গাকে উৎখাত করতে উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সরকারের বক্তব্য, তারা বেআইনি ভাবে এ দেশে ঢুকেছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে, কেন রোহিঙ্গাদের ভারত ছেড়ে যেতে হবে? জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সওয়াল করেছে, হতে পারে তারা বিদেশি, কিন্তু তারাও মানুষ, মানুষ হিসেবে যে অধিকার তাদের পাওয়ার, সেটা তাদের দেওয়া হোক। কিন্তু ভারত নারাজ। ভারতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের একটি অংশকে রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে পরিচয়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু মোদী সরকার বলেছে, সেই পরিচয়পত্রকে স্বীকার করার কোনও আইনি দায় নেই তার, কারণ উদ্বাস্তু সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে স্বাক্ষর করেনি ভারত।

আইন যা-ই বলুক, পুণ্য ভারতভূমিতে কিন্তু শরণার্থীকে তাড়ানোর চল ছিল না। হাজার হাজার বছর ধরে সে শরণাগতকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে, প্রত্যাখ্যান তার ঐতিহ্যে নেই। স্বাধীনতার পরেও— পঞ্চাশ-ষাটের দশকের তিব্বত থেকে সত্তরের দশকের বাংলাদেশ— সেই ঐতিহ্য চলেছে সমানে। সেই ভারত এখন উদ্যত রোহিঙ্গা তাড়াতে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হয়ে অন্য কোনও সম্প্রদায়ের হত, তা হলেও কি রোহিঙ্গা উৎখাতে এমন তৎপরতা দেখা যেত? কিংবা সু চি-র মায়ানমারকে যদি চিনের প্রভাব থেকে রক্ষা করার তাগিদ এতটা না থাকত, তা হলে ভারত রোহিঙ্গা-শাসনের শরিক হতে এমন আগ বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত কি? ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর ক্ষমতাসর্বস্ব কূটনীতি এ ভাবেই মানবিকতাকে হারিয়ে দেবে? তুচ্ছ করে দেবে?

মানবিকতার কথা উঠলেই ‘বাস্তববাদী’রা কঠিন স্বরে বলেন, ও সব কথা সেমিনারে আর খবরের কাগজের লেখায় ভাল লাগে, বাস্তবে যখন সমস্যার সমাধান করতে হয় তখন বন্দুক উঁচিয়ে রাখতেই হয়। কিন্তু মুশকিল হল, বন্দুকের ভাষায় সমস্যার ‘বাস্তব’ সমাধান হচ্ছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে। পশ্চিম এশিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত তার প্রমাণ দিয়েই চলেছে। রাষ্ট্র যত অমানবিক হচ্ছে, জঙ্গিবাদ তত বাড়ছে। এ প্রশ্নও তাই অনিবার্য যে, আজ ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গারা যদি ফেরত গিয়ে জঙ্গিবাদের খাতায় নাম লেখায়, তা হলে তার দায় মোদী-সরকারের ওপরেও বর্তাবে। যেমন, মাননীয়া সু চি-ও তাঁর দেশের উগ্রপন্থাকে আরও অনিবার্য করে তুলছেন, এবং এমনটা চললে আরও তুলবেন।

আসলে, সু চি-র মধ্যে হয়তো একটা দ্বন্দ্ব ছিল, বিশ্বের কাছে মানবতার প্রতীক থাকবেন, না সফল রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, মানবতার প্রশ্নে কিছুটা আপস করে সফল রাষ্ট্রনায়ক হবেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় তকমার মান রাখতে গিয়ে মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে তিনি দু-দিকে হারলেন। দু-দিক হারালেন। না হতে পারলেন মানবতার প্রতীক, না হতে পারলেন সফল রাষ্ট্রপ্রধান। বন্দুক দিয়ে সামরিক শাসন চালানো যায়, মানবতা বাদ দিয়ে সব্বাইকে নিয়ে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চালানো যায় না। নোবেলজয়ী মানবতার প্রতীক সেই সত্যটি কোনও দিনই বুঝবেন কি? বুঝলেও, মানবেন কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন