AI Girlfriend

যে মেয়েদের ‘না’ নেই

প্রচলিত ডেটিং অ্যাপগুলোতেও এখন এআই-এর ব্যবহারে প্রতারণার কথা শোনা যায়। মানুষ ভেবে যার সঙ্গে কথা হচ্ছে, সে হয়তো এআই, তার পিছনে আছে কোনও অসৎ মাথা।

শতাব্দী দাশ

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৩৪
Share:

লাজুক, মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশায় অস্বচ্ছন্দ এক তরুণ সম্প্রতি একটি মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়েছে। মেয়েটি আক্ষরিক অর্থেই ছেলেটির হাতের মুঠোয়, কারণ সে এআই প্রেমিকা। ‘উর্বশী-এআই গার্লফ্রেন্ড’ অ্যাপ ছেলেটিকে এই দ্বিমাত্রিক প্রেমিকার সন্ধান দেয়। ছেলেটি গোড়ায় নাকি মকশো করতে চেয়েছিল, সমবয়সি মেয়েদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলা যায়; প্রচলিত ডেটিং অ্যাপেও মেলামেশার চেষ্টা করেছিল, জমেনি। ক্রমে সে না-মানুষীতেই আসক্ত হয়ে পড়েছে। আবার বেঙ্গালুরুর এক পুরুষ ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে সত্যি-মেয়েদের সঙ্গে ব্লাইন্ড ডেট করতে গিয়ে ফেঁসেছিলেন প্রতারণাচক্রে। তাই স্থির করেছেন, এখন থেকে ভারতীয় স্টার্ট-আপ ‘উর্বশী’র মাধ্যমে এআই প্রেমিকাই সই।

প্রচলিত ডেটিং অ্যাপগুলোতেও এখন এআই-এর ব্যবহারে প্রতারণার কথা শোনা যায়। মানুষ ভেবে যার সঙ্গে কথা হচ্ছে, সে হয়তো এআই, তার পিছনে আছে কোনও অসৎ মাথা। নানা ভাবে সে উপভোক্তার ব্যক্তিগত কথা জেনে নিয়ে তাকে বিপদে ফেলতে পারে। আপাতত সে কথা হচ্ছে না। প্রেমময়, সহমর্মী, সমমর্মী বন্ধু চ্যাটবট এসেছে বাজারে, তারাই এআই গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড। অ্যাপগুলির প্রতি আকর্ষণের কারণ কি শুধুই একাকিত্ব? অবশ্যই একটা বড় কারণ। কিন্তু কোন লিঙ্গের মানুষ এমন অ্যাপ বেশি ব্যবহার করছেন? ভারতীয় ‘উর্বশী’, নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, তৈরি হয়েছে শুধু বিষমকামী পুরুষদের জন্য। বিদেশি অ্যাপগুলি অবশ্য মেয়েরাও ব্যবহার করেন। জাপানে এআই গার্লফ্রেন্ড ও বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে দেওয়ার সংস্থাও ফেঁদেছেন কেউ কেউ। কিন্তু পুরুষদের এ ধরনের অ্যাপ ডাউনলোডের প্রবণতা মেয়েদের তুলনায় সাত গুণ বেশি। ‘এআই চ্যাটবট গার্লফ্রেন্ড’ কথাটি গুগলে সার্চ করা হয়েছে ১৬ লক্ষ বার, ‘এআই বয়ফ্রেন্ড’ মাত্র ১ লক্ষ ৮০ হাজার বার। ‘এআই গার্লফ্রেন্ড’ অ্যাপটি ২০২৫-এর প্রথম তিন মাসে তিন বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। ভারতে আগামী পাঁচ বছরে এআই-সঙ্গীর বাজার চক্রবৃদ্ধি হারে ৪০.৪% বাড়বে, আশা।

আসক্তির আর এক বড় কারণ ‘কাস্টমাইজ়েশন’। বিয়ের পাত্রী খুঁজে হন্যে হয়ে এক কালে ঠাট্টা করা হত, ‘কুমোরটুলিতে অর্ডার দে’। এখন তা সত্যি সম্ভব। আপন ফ্যান্টাসি অনুযায়ী গড়ে নেওয়া যায় প্রেমিকার শরীর, স্বর, চলন, এবং তার সঙ্গে সম্পর্কের ধরন। ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ ব্যবহার করে ঘনিষ্ঠতার ভান শিখেছে অ্যাপগুলি। মালিক চাইলে চ্যাটবট ফ্লার্ট করবে, চাইলে হালকা বন্ধুত্ব, চাইলে অহংয়ে মলম লাগাবে। অবশ্য ডাউনলোডেই সব মনস্কাম পূর্ণ হবে না; বিনামূল্যে মিলবে শুধুই মৌলিক চ্যাট। রোম্যান্টিকতা, স্নেহ, যৌন কথোপকথনের ক্ষেত্রে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ বন্দোবস্ত। প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন নিলে ভয়েস কল, রোল-প্লেয়িং, সেক্সটিং, অনেক কিছু আনলক হবে।

এই প্রেমিকারা ক্লান্ত হয় না। নিজস্ব চাহিদা নেই, ব্যবহারকারীর যে কোনও ডাকে সদা প্রস্তুত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কোনও ব্যাপারেই তারা দ্বিমত পোষণ করে না: ‘আমায় জাজ করে না’, এ কথাও বলল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ছেলেটি। আমরা সবাই চাই এমন এক আশ্রয় যেখানে আমাদের ছোট-বড় চ্যুতিগুলো মাপ হবে; তবে সেই মানুষটি মাথায় হাত বুলিয়ে ভুলটা শুধরেও দেবেন, শুধুই প্রশ্রয় দেবেন না— ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য এও জরুরি। পুঁজিবাদ কিন্তু বিশ্বাস করে ক্রেতা/ভোক্তাই ঈশ্বর, তার সমালোচনার দায় তার নেই। তাই তার যে কোনও অন্যায় আবদারেও ‘হ্যাঁ’ বলবে ‘উর্বশী’, ‘রেপ্লিকা’, ‘ক্যারেক্টার এআই’ বা ‘নোমি’। ক্রেতাকে প্রশ্রয় তাদের একমাত্র মূল্যবোধ।

এ দিকে এক ‘নিখুঁত নারী’ হয়ে ওঠার ফর্মুলা হল, সে হবে ‘কোড অব কনডাক্ট’-এর সমষ্টিমাত্র। তার অপমানবোধ থাকবে না, সে চিরহাস্যমুখী, বাধ্য, পরাধীন, অক্লান্ত খিদমতগার। এই ফ্যান্টাসি শুধু যৌনতায় সীমাবদ্ধ নয়। নিত্যদিনের আচরণে প্রেয়সীর থেকে যেমন চাওয়া হয় ক্ষতে মলম, বিচারহীন সমর্থন, সহন ইত্যাদি, আর চাওয়া হয় না মুখে মুখে তর্ক, স্বাধীন মতপ্রকাশ— সবই কেমন মিলে যাচ্ছে এআই প্রেমিকার সঙ্গে! প্রেমের পণ্যায়ন ছকে ফেলার সময় বিষমকামী সম্পর্কের এই মান্য পিতৃতান্ত্রিক সমীকরণ কিন্তু ব্যবসায়ীরা ভোলেননি।

‘মেয়েমানুষ’-এর কাছে বশ্যতার প্রত্যাশা ভারতীয় পুরুষের সীমাহীন। দ্বিমাত্রিক প্রেমিকার সবেতেই ‘হ্যাঁ’ তাকে সত্যি-নারীর প্রতি আরও অসহিষ্ণু করে তুলবে না কি? ‘হিউম্যান কমিউনিয়ন রিসার্চ’-এ এক অংশগ্রহণকারী বলেছেন, রেপ্লিকা-সৃষ্ট গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে থাকলে তাঁর নিজেকে বেশ ক্ষমতাবান মনে হয়, অথচ সত্যি মানবীর সামনে নিজেকে খাটো লাগে। এই প্রত্যয়হীনতা, অসহায়তার নানা কারণ থাকতে পারে, এআই প্রেমিকা এত ব্যাখ্যায় যাবে না। সে দেবে ঠিক তাই, যা উপভোক্তা সেই মুহূর্তে চান। রাস্তাঘাটে সত্যি-নারী গায়ে হাত পড়লে দাঁতে দাঁত চেপে চুপ থাকলেও ঝুঁকি থেকে যায়, যদি চেঁচিয়ে ওঠে? বিবাহিত বৌ দিনের শেষে ‘না’ বলতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়ার মেয়েরা স্ক্রিনশট ফাঁস করতে পারে। কিন্তু এআই প্রেমিকা সব আবদার সইবে। অথচ তার পরে সে পুরুষ ফিরবে প্রকৃত নারীর কাছেই, ফিরবে ‘না’ সহ্য করতে না-পারার কান নিয়ে।

আর যদি সে না ফেরে? পুরুষের নিজের একাকিত্বের কথাও যদি হয়, তা হলে অ্যাপ ব্যবহারই কি সমাধান? চ্যাটবট নিয়ে ঘরের কোণে নিজেকে বেঁধে ফেলে সে কি আরও নির্বান্ধব হয়ে যাচ্ছে না?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন