উগ্র হিন্দুত্বের প্রকোপে আজ এই দলিত বিক্ষোভের আগুন

রাজনীতির চালে ভুল

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সংবাদমাধ্যমই একতরফা আমাদের জাতপাত আর ধর্মীয় মেরুকরণের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৩
Share:

যোদ্ধাবাহিনী: ভীমা-কোরেগাঁও তাণ্ডবের পর মুম্বই-থানে হাইওয়ে অবরুদ্ধ করে দলিত বিক্ষোভকারীদের বাইক মিছিল, ৩ জানুয়ারি। ছবি:পিটিআই

কলকাতার মতো দিল্লিতেও পুরনো কফি হাউস আছে। কনট প্লেসে হনুমান মন্দিরের পাশেই দোতলায় সেই কফি হাউসটির আজ বেশ মলিন দশা। তবু রাজধানীর নাগরিক সমাজ সেখানে আজও আড্ডা দেয়। সেখানে খোলা ছাদে শনিবার শীতের দুপুরে পুরনো আড্ডায় শুধু বাঙালি নয়, উত্তর ভারতের প্রায় নাৎসিদের মতো উগ্র কিছু বন্ধুও আসেন। আবার কাঁধে ঝোলা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি লোহিয়াপন্থী হিন্দিভাষী সমাজতন্ত্রীরাও শামিল হন। আমরা বলতাম এ যেন চাচাকাহিনির বার্লিনের ‘হিন্দুস্তানি হৌস’।

Advertisement

সে দিন শনিবারের আড্ডায় সুরেশ আস্তানা তাঁর খাদির জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে প্রশ্ন তুললেন, আরে ভাই, তিন সাল হো গয়া, হামহারা বিকাশবাবু কহা গয়া? জেএনইউ–এর রিসার্চ স্কলার অপরাজিতা ফস্ করে একটি সিগারেট ধরিয়ে বললেন, কে আমাদের বিকাশদা? নরেন্দ্র মোদী? অর্থনীতির এই বেহাল দশা, মুখ থুবড়ে পড়া জিডিপি দেখে তিনি নিখোঁজ। এই পঞ্চভূত ক্লাবের ‘নাৎসি সদস্য’ (আমরা তাকে ওই নামেই ডাকি) বিশ্বেশ্বর শর্মা বললেন, উন্নয়ন হচ্ছে, তোমরা দেখতে পাচ্ছ না। এই যে বিশাল অম্বেডকর ভবনের দ্বারোদ্‌ঘাটন করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, পিছিয়ে পড়া চিহ্নিত জেলার উন্নয়নের জন্য বৈঠক করলেন, সেটা কী? অম্বেডকরের মূর্তিকে প্রণাম করে তিনি তো সামাজিক ঐক্যকেও প্রতিষ্ঠা করলেন। তোমাদের সমস্যা কী হয়েছে জানো, পছন্দ করো না যাকে, সে সুন্দর হলেও বলবে কী কুৎসিত!

ঠিক এই কথাটাই সে দিন সংসদ ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় অমিত শাহও বলছিলেন। আমরা উন্নয়নেই আছি। আমরা সমাজের মধ্যে জাতিভেদের ভাবনা আনছি না। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সংবাদমাধ্যমই একতরফা আমাদের জাতপাত আর ধর্মীয় মেরুকরণের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

Advertisement

সত্যি কি তাই? মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিতদের উপর ঘটনায় বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের উপরই অভিযোগের তর্জনী উঠেছে। বিদ্রোহের আগুন মহারাষ্ট্র থেকে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ এমনকী অন্য রাজ্যগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই বিদ্রোহের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়েছে। তার জন্য কি তবে সংবাদমাধ্যম‌ই দায়ী?

আমার মনে হয়, ২০১৪ সালের ভোটে জিতে যে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আমরা কোটি কোটি মানুষ আস্থা রেখেছিলাম, তার দলীয় রণকৌশল যা-ই হোক না কেন, প্রধান ভাবমূর্তিটি ছিল বিকাশ পুরুষের। গত তিন বছরে দেখা গেল, জিডিপি বৃদ্ধি শতকরা ৬.৫ হয়ে গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম হওয়ার রেকর্ড অর্জন করেছে। বিনিয়োগ নেই, চাকরি নেই, সেই মাটি কাটার কাজের সামাজিক দায়বদ্ধতার কাছেই আত্মসমর্পণ। তখন বিজেপি আবার শর্টকার্ট রাস্তায় ভোট জেতার জন্য উগ্র বর্ণ-হিন্দুত্বের আগ্রাসী কৌশলের শরণাপন্ন। গত তিন বছরে এক দিনের জন্যও কি বিজেপি তাদের প্রাচীন হিন্দুত্ব-ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র-হিন্দি জাতীয়তাবাদ এমনকী নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছে? না। আসেনি।

এই উগ্র হিন্দুত্বের অ্যান্টি-থিসিস হয়েই দলিত আন্দোলন আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। এক জন দলিত রাষ্ট্রপতিকে মনোনীত করার মধ্যে ‘টোকেনিজম’ থাকতে পারে, কিন্তু এক জন রামনাথ কোবিন্দকে দিয়ে যে দেশের দলিত সমাজের যন্ত্রণার উপশম হয় না, সে তো এই নব্য-আন্দোলনেই প্রমাণিত। দলিত আন্দোলনের নেতাদের মুখও বদলে যাচ্ছে। কাঁসিরাম ও তার পর মায়াবতী একদা দলিত-নিম্নবর্গের আশা-নিরাশার প্রাচীন মুখ ছিলেন। সেই মায়াবতী মানেও আজ মার্সিডিস গাড়ি, তাজ করিডর দুর্নীতি। আর তাই ভীমসেনা নামক নতুন দলের নেতা সে রাজ্যে বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো চন্দ্রশেখর। দিল্লির কানহাইয়া, হায়দরাবাদের রোহিত ভেমুলার মা আন্দোলনের নতুন-নতুন মুখ। এমনটাই তো হয়। আপনারা মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে চেনেন? সমাজ যাদের ম্লেচ্ছ, ছোট জাত, শিক্ষিত, চণ্ডাল বলে অভিহিত করে থাকেন, তাদের অন্যতম প্রতিনিধি তিনি। কলকাতাবাসী কুলি, হোটেলে বাসনমাজার বয়, রিকশাচালক, ট্রাকের খালাসি মনোরঞ্জন আজ জয়পুরের বাৎসরিক সাহিত্য মোচ্ছবে আমন্ত্রিত অভিজাত-দলিত সাহিত্যিক। একেই বলে ঊর্ধ্বমুখী সামাজিক সচলতা!

সামাজিক সচলতার পাশাপাশি আরও একটা সত্য স্পষ্ট। ১৯৫০ সালের সংবিধানে যে বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছিল, অম্বেডকর যে কোটা সিস্টেমের দাবি তুলে এই অস্পৃশ্য সমাজে শিক্ষার বিকাশ চেয়েছিলেন, আজও সেই শিক্ষা অধিকাংশ নিম্নবর্গ সমাজে পৌঁছয়নি। শুধু দলিত নয়, পাতিদার, জাঠ, মরাঠাদেরও একাংশ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। অম্বেডকর সিডিউল ক্লাস ফেডারেশন করেন ১৯৪২ সালে। ১৯৫৬ সালে তৈরি হয় রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়া কিন্তু, ভারতের রাজনীতিতে দলিতদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক দল অতীতে কখনওই সে ভাবে সাফল্য অর্জন করেনি। কংগ্রেস দলেই ছিল দলিত ভোট ব্যাংক। আরপিআই মহারাষ্ট্রের বাইরে কখনওই যেতে পারেনি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে কাঁসিরাম বহুজন সমাজ পার্টি বলে নতুন দল করেন। তবু গাঁধীর হরির সন্তানরা আজও কংগ্রেস দলের মধ্যে নিজেদের সম্পর্কের শিকড় খুঁজে পান।

বিজেপি রামমন্দির আন্দোলনের সময় ছিল প্রতিবাদী দল, আর মোদী জমানায় বিজেপি চেয়েছিল প্রতিবাদী থেকে সুশাসনের দলে পরিবর্তিত হতে। মনে রাখতে হবে, অযোধ্যা আন্দোলনের সময় উচ্চবর্ণ হিন্দু সুসংহত হয়ে বিজেপির পাশে এসে দাঁড়ায় আর মণ্ডল কমিশনের রাজনীতির জন্য দলিত ও নিম্ন জাতিবর্গ বিজেপির দিকে না গিয়ে বিজেপি-বিরোধী দলগুলিতে আশ্রয় নেয়। আজ মোদীর বিজেপি তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পরও সুশাসনের দল হতে পারছে না উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রাবল্যে। আবার আডবাণী যেমন দলিত সমাজকে কাছে টানার চেষ্টা করেছিলেন মণ্ডল-উত্তর রাজনীতিতে, আজ দলিত পরিবারে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজনের মাধ্যমে অমিত শাহ সেই একই চেষ্টা করলেও, মনু-সংহিতার উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ব তাতেও জল ঢেলে কাজ পণ্ড করে দিয়েছে। আরএসএস–এ আজ সরসংঘচালক প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ, এ বার এক জন এক জন দলিতকে সরসংঘচালক করুক না কেন আরএসএস।

ইতিহাস বড় রোমাঞ্চকর। কেমন ফিরে ফিরে আসে। ’৭৭ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। কিন্তু বিহারের বেলচি গ্রামের একটি ছোট ঘটনা দেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ’৭৭ সালের ২৭ মে ৯ জন হরিজনকে উচ্চবর্ণের একদল লোক পুড়িয়ে মারে। ইন্দিরা হতাশ হয়ে রাজনীতি ছেড়ে হিমালয়ের কোনও কুটিরে থাকার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু বিহারের এই হত্যাকাণ্ড তাঁকে আবার সক্রিয় করে তুলল। তাঁর সহজাত রাজনৈতিক বোধ তাঁকে বলল, দেশের রাজনীতির মোড় এই দলিত হত্যাকাণ্ডে ঘুরে যাবে। কেউ তখনও অকুস্থলে যাননি। তিনি পটনা হয়ে বেলচি পৌঁছে যান। রাস্তা ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। গাড়ি গেল না। জিপ নিয়ে যাত্রা শুরু। তার পর ট্রাক্টর। গাড়ির কাদা। নিতে হল হাতি। এ ভাবে বেলচি পৌঁছলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। হিংসার বলি দলিত পরিবারকে শুধু সান্ত্বনা জানাতে। সে দিন থেকে ইন্দিরাকে আর পিছন ফিরতে হয়নি।

আসলে জনতা সরকারের আমলে (জনসংঘ সে সরকারের শরিক ছিল) বর্ণ-সংঘর্ষ অনেক বেড়ে যায়। ইন্দিরা জমানায় দশ বছরে ৪০ হাজার ঘটনা হয় আর মোরারজি আমলে প্রথম বছরেই হরিজনদের ওপর ১৭,৭৭৫টি ঘটনা ঘটে। শুধু অগ্রসর উচ্চবর্ণ নয়, অনগ্রসর গ্রামীণ জোতদার গোষ্ঠীও দলিতদের ওপর অত্যাচারটা শিখে ফেলেছিল তদ্দিনে।

এক দিন মহাত্মা গাঁধী হরিজনের রাজনৈতিক পরিসরের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আজ ২০১৮ সালে, আমরা দেখছি আর এক গাঁধী, রাহুল গাঁধীকে, যিনি গোটা দেশের এই বিরাট দলিত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁর আন্দোলন ক্রিয়া নয়, প্রতিক্রিয়া। নিউটনের তৃতীয় সূত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন