সম্পাদকীয় ২

বন্ধন ও রক্ষা

সার্কুলারটি পরে প্রত্যাহৃত হইয়াছে বটে, কিন্তু উহা যে আদৌ জারি করা হইয়াছিল তাহা যথেষ্ট উদ্বেগের, এবং অবশ্যই কৌতুকের জন্ম দেয়। রাখি সাধারণত ভগ্নীরা ভ্রাতাদের পরাইয়া থাকেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share:

গত মঙ্গলবার দমন ও দিউয়ের প্রশাসন এক সার্কুলার জারি করিলেন: ৭ অগস্ট ‘রক্ষাবন্ধন’ উপলক্ষে সরকারি অফিস খোলা রাখিতে হইবে, যাহাতে সকল মহিলা কর্মী সকল পুরুষ কর্মীর হস্তে রাখি পরাইয়া দিতে পারেন। সার্কুলারটি পরে প্রত্যাহৃত হইয়াছে বটে, কিন্তু উহা যে আদৌ জারি করা হইয়াছিল তাহা যথেষ্ট উদ্বেগের, এবং অবশ্যই কৌতুকের জন্ম দেয়। রাখি সাধারণত ভগ্নীরা ভ্রাতাদের পরাইয়া থাকেন। প্রচলিত রসিকতা অনুযায়ী, কোনও অনাত্মীয় নারী কোনও পুরুষকে রাখি পরাইয়া দিলে, প্রতিষ্ঠিত হয়: নারীটি সেই পুরুষের সহিত প্রণয়সম্পর্কের সম্ভাবনা বিকশিত হইতে দিতে চাহেন না। এই রাখি পরাইয়া দেওয়া তাই ভ্রাতৃত্বের পরিচায়ক নহে, অনেকটা প্রেমের প্রতিষেধক। পাছে প্রণয়প্রস্তাব আসে, তাই পূর্বাহ্ণেই গৃহীত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।

Advertisement

সন্দেহ হয়, প্রশাসন ভারতবাসীকে এই অর্থে ‘রক্ষা’ করিতেই সার্কুলারটি জারি করিয়াছিল। অফিসময় ভ্রাতা ও ভগ্নীর সম্পর্ক বিকশিত হউক— ইহার অন্তরালে প্রকৃত বার্তাটি হইল: সহকর্মীদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক যেন না বিকশিত হইয়া পড়ে। ইহাতে অবশ্য একই অফিসে কর্মরত স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক ভয়াবহ জটিল হইয়া পড়িত, কারণ সার্কুলার অনুযায়ী পরস্পরের সহিত অযৌন সম্পর্কের কড়ার করিবার পর তাঁহারা সংসারে ফিরিয়া কি সরকারি ফরমান অস্বীকার করিতেন? এহ বাহ্য। যদি ধরিয়া লওয়া যায়, সকল সহকর্মীই অসম্পর্কিত, তাঁহাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়িয়া উঠিলে সরকারের অসুবিধা বা আপত্তির কারণ কী? সম্ভবত প্রশাসন ভাবিয়া দেখিয়াছেন, অফিসে প্রেম হইলে যুগলে কেবল সুমিষ্ট গুজগুজ হইবে, অথবা উৎকণ্ঠা ও দীর্ঘশ্বাসের চাপ সামলাইতেই অফিস ফুরাইয়া যাইবে, ফাইল টেবিলেই পড়িয়া থাকিবে। কর্মনাশা প্রেমের ফাঁদে যাহাতে কেহ না পড়েন, তাহার নিমিত্ত বোধ হয় এই বার অফিসে অ্যান্টি রোমিয়ো (ও অ্যান্টি জুলিয়েট) স্কোয়াডও গঠিত হইবে। ভারতীয় জনগণকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবিবার অভ্যাস এই সরকারের নাই।

ইহাও সন্দেহ, সরকারের মৌলিক ধারণা: প্রেম এক প্রকারের পাপ। এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের সহিত ইহা প্রকাণ্ড অসমঞ্জস। বর্তমান সরকার হিন্দুত্ব বলিতে যাহা বুঝেন, এবং সমগ্র দেশের স্কন্ধে চাপাইতে চাহেন, তাহার মধ্যে এক অযৌন ও অপ্রেমল নিরামিষ নীরস সংযমের দ্যোতনা রহিয়াছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি হইতে এই বার্তা নিরন্তর বিকিরিত। ভারতের সেন্সর বোর্ড যে ছবিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দাগিয়া দিতেছে, তাহাতেও ৪৮টি কাট দাবি করিতেছে, বিদেশি ছবিতে চুম্বনের দৈর্ঘ্য কমাইতেছে, তাহার কর্তা আন্তর্জালে প্রকাশিত ট্রেলরেও যৌন সঙ্গমবাচক ইংরাজি শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে তড়পাইতেছেন। যে গুন্ডাবাহিনী ভ্যালেন্টাইন’স ডে উপলক্ষে লাঠি লইয়া দাপায় ও যুগল দেখিলে অপমান ও নির্যাতন করিয়া আনন্দ পায়, তাহাদের মনোবৃত্তির সহিত ইহার মিল রহিয়াছে। যেন শুচিবায়ুগ্রস্ত ব্রহ্মচারী ভারতই প্রকৃত ও একমাত্র ভারত, খাজুরাহোর ভারতের অস্তিত্ব নাই। ময়ূরী যেন সত্যই ময়ূরের অশ্রু পান করিয়া গর্ভবতী হয়। আজ যে সার্কুলার প্রত্যাহার করা হইয়াছে, কাল তাহা পুনরায় বহাল হওয়ার সম্ভাবনা হইতে এই দেশকে রক্ষা করিবে কোন সুবুদ্ধি ও সুচেতনার বন্ধন, তাহাই প্রশ্ন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন