কিছু দিন পূর্বেই ‘দঙ্গল’ ছবিটি ভারতকে মাতাইয়া তুলিয়াছিল। এক পিতা তাঁহার কন্যাদের কুস্তির খেলোয়াড় বানাইতেছেন ও তাহারা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করিতেছে, এই কাহিনি লইয়া নির্মিত ছবিটি সাধারণ মানুষের মন জিতিয়া লইয়াছিল। এই মুহূর্তে ছবিটি চিনের মন জিতিতেছে। সপ্তম বেজিং আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসবে ছবিটি প্রবল সমাদর পাইয়াছিল, ছবির শেষে দর্শকগণ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এই মাসে ছবিটি চিনে বাণিজ্যিক ভাবে মুক্তি পাইয়াছে ও ইতিমধ্যেই হইয়া গিয়াছে ওই দেশে সর্বাধিক সফল ভারতীয় ছবি, আর কিছু দিনের মধ্যে সর্বকালের সফলতম বিদেশি ছবি হইয়া যাওয়া আশ্চর্য নহে। দঙ্গলের অভিনেতা আমির খান ইহার পূর্বেই চিন দেশে তারকা, তাঁহার অভিনীত ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিটিও এই দেশে বিশাল ব্যবসা করিয়াছিল। দঙ্গল ছবিটিতে পিতা যে মেয়েদের সমাজ-নির্ধারিত ভূমিকার বাহিরেও কিছু হইয়া উঠিবার প্রেরণা দিতেছেন এবং এক পুরুষ-প্রধান ক্রীড়ায় তাহাদের সফল করিতেছেন, এই বার্তা চিনকেও উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। অনেকেই ইহাকে নারীশক্তির সমর্থক ছবি হিসাবে প্রশংসা করিতেছেন। চিনের সোশ্যাল নেটওয়ার্কেও ছবিটির প্রশস্তি ছাইয়া গিয়াছে। ছবিটি সত্য ঘটনার উপর আধারিত, হরিয়ানার এক কুস্তিগির ও কোচ সত্যই তাঁহার দুই কন্যাকে কুস্তি শিখাইয়া এমন পর্যায়ে লইয়া যান যে এক কন্যা কমনওয়েলথ গেমস-এ স্বর্ণপদক জিতিয়া লয় এবং অলিম্পিকে সুযোগ লাভ করে। অন্য কন্যা রৌপ্যপদক জেতে। বাল্যবিবাহ এবং লিঙ্গবৈষম্যের আধিক্যে লাঞ্ছিত একটি প্রদেশ হইতে এমন মানুষের উঠিয়া আসা সহজ নহে। সংবাদপত্রে তাঁহার কথা পড়িয়া একটি প্রযোজক সংস্থার এক কর্ণধার পরিচালককে এই লইয়া চিত্রনাট্য লিখিতে বলেন। হয়তো বাস্তবের সহিত এই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধই ছবিটিকে অধিক আকর্ষক করিয়া তুলিয়াছে।
বলিউড ছবির বিরুদ্ধে চিনের সাধারণ দর্শকদের অভিযোগ ছিল, সেগুলি অনাবশ্যক দীর্ঘ ও অপ্রাসঙ্গিক নৃত্যগীতের দৃশ্যে বিশ্বাসী। এই ছবির ক্ষেত্রে সেই অভিযোগ স্তিমিত হইয়া গিয়াছে। চিনে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছবির শেষে প্রায়ই হাততালি পড়িতেছে। কেহ বলিয়াছে, কাহিনিটি দর্শকদের এমন হাসাইয়াছে কাঁদাইয়াছে, অসামান্য কাহিনিচিত্র না হইলে তাহা সম্ভব হইত না। কেহ বলিতেছে, চিনের মূল ধারার চলচ্চিত্রের এই ছবিটির নিকট শিক্ষা লওয়া উচিত, কেমন করিয়া একটি সত্য ঘটনাকে বিনোদন-আবৃত করিয়া পরিবেশন করিতে হয়। কেহ আপশোস করিতেছে, চিনেও তো বিভিন্ন ক্রীড়ায় অসামান্য কৃতীর সংখ্যা কম নহে, তবে এমন ক্রীড়াভিত্তিক ছবি বিরল কেন? অবশ্যই নিন্দুক রহিয়াছে, তাহারা বলিতেছে, ছবিটি আদৌ নারীশক্তির প্রশস্তি গাহে না, এক পিতার ব্যর্থ স্বপ্ন পূরণ করিবার দায় তাঁহার কন্যাদের উপর চাপাইয়া দেওয়াকে পুরুষ-শাসনেরই জয় বলে, সাধারণ দর্শকেরা উপরের আস্তরণ খুঁটিয়া ভিতরের নারীদ্বেষী কথাগুলি বাহির করিতেছেন না বলিয়া ঠকিতেছেন ও ভুল কারণে তালি বাজাইতেছেন। এই ধরনের সমালোচনা এই দেশেও হইয়াছিল, ছবিতে মল্লযোদ্ধা-কন্যার লিপস্টিক বা নেলপালিশ পরিবার সহিত সাধনা-চ্যুতির যে সমীকরণ, তাহা লইয়াও কেহ কেহ সরব হইয়াছিলেন। কিন্তু নিন্দা অতিক্রম করিয়া ছবিটি উতরোল সমাদরের দিকেই ছুটিতেছে।
বলিউডি ছবি এখন অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মহাতারকারা বহু দেশে সমাদৃত, হিন্দি ছবি সাবটাইটেলের উপর ভর করিয়া বহু সাগর পাড়ি দিতেছে। ইহার একটি বড় বিপদ হইল, বিদেশে অধিকাংশ মানুষই ভারতীয় ছবি বলিতে কেবলমাত্র হিন্দি ছবিকেই বুঝিতেছে। অথচ ভারত এক বিশাল দেশ, ইহার বহু প্রদেশে বহু ভাষায় বহু ভঙ্গিতে ছবি হইতেছে। ভারতের ছবি বিখ্যাত হইলে তাহা ভারতীয়ের পক্ষে অবশ্যই গর্বের, কিন্তু কেবলমাত্র একটি ভাষার চলচ্চিত্রকেই ভারতীয় ছবি ভাবিলে, বা, কেবলমাত্র মূল ধারার বিনোদন-বিতরণকারী ছবিকেই ভারতীয় ছবির একমাত্র প্রবণতা ভাবিলে, তাহা হইবে দুর্ভাগ্যজনক খণ্ডদর্শন। তাহা ভারতীয় ছবির পক্ষে ও ছবির সত্যকার অনুরাগী ও সমঝদারদের পক্ষে শুভ সংবাদ নহে। যদি চিনে আজ ভারতীয় ছবিকে লইয়া যে হইহই উঠিয়াছে তাহার সুযোগ লইয়া ভারতীয় সরকার ওই দেশে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার বিভিন্ন প্রকারের ছবির প্রদর্শন আয়োজন করিতে পারেন, তবেই অচিন সাফল্যের সমীপবর্তী হইবার সম্ভাবনা বাড়িবে।
যৎকিঞ্চিৎ
ক্যালিফোর্নিয়ার পনেরো বছরের কিশোরী য়ুসরা রফিকি ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছেন প্ল্যাকার্ড নিয়ে, লেখা: এক মুসলিম পরিবারের সঙ্গে খাবার খেয়ে যান। ধীরে ধীরে সাড়া মিলছে, সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ আমন্ত্রণ গ্রহণ করছেন। হয়তো সুস্বাদু বিরিয়ানি খেয়ে ও রফিকির পরিবারের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে, বাড়ি ফিরছেন এই বোধ নিয়ে: এঁরা তো উগ্রপন্থী বা ভিনগ্রহী নন! এমন প্রয়াস আরও হচ্ছে, ছোট্ট ও ব্যক্তিগত চেষ্টাগুলো ট্রাম্পের দেশের অপমানচিত্র বদলে দেবে, আশা!