স ম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ বড় ধাক্কা খেয়েছে। বেশ কয়েক বছর পরে তারা সভাপতি এবং সহ-সভাপতির পদ দুটি খুইয়েছে কংগ্রেস সমর্থিত এনএসইউআই-এর কাছে। এ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বেশ শোরগোল উঠেছে, এমনকী কাগজে কাগজে কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে বিজয়ী ছাত্রনেতাদের সহাস্য মুখের ছবিও বেরিয়েছে বেশ ঘটা করে। কারণটি সহজবোধ্য। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদকে কংগ্রেস এবং বিজেপি তাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে দেখে থাকে। অরুণ জেটলি থেকে অজয় মাকেন, অনেকেরই রাজনীতির হাতেখড়ি এখানেই। আর তাই, এই ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ স্বাভাবিক।
ছাত্রদের একটা বড় অংশ একই সঙ্গে এটাও বলছে যে এই নির্বাচনের ফলাফল যতটা এনএসইউআই-এর পক্ষে, তার চেয়ে অনেক বেশি এবিভিপি-র বিপক্ষে। বিশেষত এই বছরের গোড়ায় রামজস কলেজে একটি সেমিনারে জেএনইউ-এর বামপন্থী ছাত্রনেতা উমর খালিদের অংশগ্রহণ আটকাতে এবিভিপির সমর্থকদের আক্রমণ ও তার পরে পুলিশের আচরণকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত ও অশান্তির সৃষ্টি হয়, সেই ঘটনাবলির পর ছাত্রসমাজের একটা বড় অংশের মধ্যে সংঘ পরিবারের হিংসা আর ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এ বারের নির্বাচনী ফলাফল। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মতো— সংঘ-রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এ বারের নির্বাচনে বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন সব মিলিয়ে প্রায় এগারো হাজারের মতো ভোট পেয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমনটা খুব বেশি দেখা যায়নি।
এই নির্বাচনের স্বরূপটা আর একটু তলিয়ে বুঝতে গেলে কয়েকটি জিনিস মাথায় রাখা জরুরি। প্রথমত, এ বারের নির্বাচনে রামজস কলেজের ঘটনাটি বেশ বড় প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘ দিন ধরেই সংঘ এবং তার অজস্র সংগঠনের মাধ্যমে উত্তর ভারতের একটা বড় অংশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দখল করার চেষ্টা হচ্ছে। মূলত জবরদস্তি করে, হিংসা আর ভয় ছড়িয়ে। রামজসের ঘটনাটা দেখিয়ে দিয়েছে যে, সংঘ আর কোনও বিরুদ্ধ মতামতই সহ্য করতে রাজি নয়। দরকার হলে তারা ছাত্র এবং শিক্ষকদের মারবে, প্রতিবাদ চেপে দিতে পুলিশ প্রশাসন ব্যবহার করবে এবং একটা ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করবে। ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকদের হুমকি দেওয়ার সঙ্গে চোরাগোপ্তা আক্রমণও চলছে তাদের ওপর। কোনও রকম গণতান্ত্রিক আলোচনা চালানো প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমনকী, কোনও বিভাগের আয়োজন করা আলোচনাসভা পছন্দ না হলে তাদের পুলিশের জেরার সামনেও পড়তে হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে এ বারের নির্বাচনী ফলাফল একটা মস্ত প্রতিবাদ। এই নির্বাচনে এবিভিপি-র বিরোধী প্রায় সব ছাত্রদলের একটিই স্লোগান ছিল: ‘সন্ত্রাস-মুক্ত ক্যাম্পাস’। নির্বাচনের ফলে এটা পরিষ্কার যে, একটি বৃহৎ সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এই হিংসার রাজনীতি মেনে নেয়নি।
এর সঙ্গে একটি দ্বিতীয় বিষয় উল্লেখ করা খুব জরুরি। এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠনগুলো লড়াই করেছে, তার পাশাপাশি, কখনও আরও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, আরও অনেকগুলো সংগঠন একত্র হয়েছে। সারা বছর ধরে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই প্রতিরোধ একটি অন্য রাজনীতির কথা বলেছে, একটি অন্য ভাষা তৈরি করেছে। এখানে সবচেয়ে উল্লেখ্য হল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠন, ‘পিঁজরা তোড়’। এই লেখার সীমিত পরিসরে কেবল সেটির কথা একটু বিশদ ভাবে বলব। এই সংগঠনের জন্ম হয় এক ‘স্বশাসিত সংগঠন’ (অটোনমাস কালেকটিভ) হিসেবে, আর এদের প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন মহিলা হস্টেলের চাপিয়ে দেওয়া খামখেয়ালি নিয়মাবলি। যেখানে পুরুষদের হস্টেলে এই জাতীয় কোনও বিধিনিষেধ নেই, সেখানে মহিলাদের জন্যই শুধু কেন এমন নিয়ম থাকবে— এই ছিল আন্দোলনের মূল কথা। আর তার
থেকেই হস্টেলের খাঁচা ভাঙার ডাক। খুব তাড়াতাড়ি এই আন্দোলন হস্টেলের বাইরে একটি বৃহত্তর পরিসরে ছ়ড়িয়ে পড়ে। ছাত্রীরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকে, জনমত গড়ে তোলে। কখনও তা শহরের জনপরিসরে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে, কখনও অন্য যৌনতার অধিকারের পক্ষে, কখনও বা আবার রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর যথাযথ তদন্তের দাবিতে।
‘পিঁজরা তোড়’ সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু তার মানে একেবারেই এই নয় যে, এটি একটি অ-রাজনৈতিক সংগঠন। প্রথম থেকেই তারা তাদের বিরুদ্ধ পক্ষকে দ্বিধাহীন ভাবে চিহ্নিত করেছে— এবিভিপি এবং বৃহত্তর সংঘ পরিবার। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ যে আসলে নারীদের বা নানা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রস্ত করে নিজের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে চায়, ছাত্রীরা শুরু থেকেই বার বার তা বলে এসেছে। শুধু বলা নয়, তারা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এমনই একটি কর্মসূচি ‘এবিভিপি খবরদার’। গত বছর অক্টোবর মাসে দিল্লির বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পিঁজরা তোড়-এর পক্ষ থেকে অনেকগুলো মিছিল, ধরনা বা প্রতিবাদ সভা করা হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল সংঘের ছাত্র সংগঠনটি। এই মিছিলগুলো কিছু নতুন স্লোগানের জন্ম দেয়: ‘করেঙ্গে পলিটিক্স করেঙ্গে প্যার, এবিভিপি খবরদার’, ‘এবিভিপি ইজ লাইক আ ব্রা, ইট ওন্ট লেট ইউ ব্রিদ’ বা ‘ফেমিনিস্ট সে পঙ্গা, এবিভিপি কো পড়েগা মেহেঙ্গা’। এই স্লোগানগুলোর তাৎক্ষণিকতার বাইরে একটা গভীর সুর আছে, যেটা চেনা দরকার। সেই রাজনীতি নিজের শরীর, যৌনতা, প্রেম, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে সংকুচিত তো নয়-ই, উল্টে সেগুলোকেই হাতিয়ার করে তুলতে চায়। এখানে খাঁচাটি আর শুধু হস্টেল নয়, তা বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। সেখানে পিতৃতন্ত্র, ‘সংঘবাদ’, ক্যাম্পাসে বা শহরে প্রাত্যহিক যৌন হয়রানি, যৌন সন্ত্রাস, সব কিছুই এই রাজনৈতিক উচ্চারণের এক একটি লক্ষ্য। আর, তার সঙ্গে, প্রতিবাদ এমন একটি রাজনৈতিক মতদর্শের বিরুদ্ধে, যা এই সব হয়রানি আর হিংসাকে প্রশ্রয় দেয়, এগুলোকে নিয়ে নিজের রাজনৈতিক চাল তৈরি করে।
এবিভিপি-র বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে এই টুকরো টুকরো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, এদের জেদ আর সাহসের ওপরে ভিত্তি করে। এই ছাত্রীরা রোজকার জীবনকেই রাজনীতির নতুন ভাষায় তুলে এনেছে, আর প্রতিবাদ জানিয়েছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে। তাই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা পঞ্জাব, রাজস্থান, অসমের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিভিপি-র ভরাডুবির কারণ কেবল দুটো রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাতের গল্পে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তা খুঁজতে হবে এই দৈনন্দিন রাজনীতিতে, রোজকার বিরোধিতায়। ‘পিঁজরা তোড়’ এই নতুন রাজনীতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক