National News

নাবালক গণতন্ত্র দায় নিতে শেখেনি এখনও

জলাধার ধসে গিয়েছে বিহারে, উদ্বোধনের ঠিক আগের দিন ঘটেছে বিপর্যয়, বাঁধ-ভাঙা হু হু প্লাবন ভাসিয়ে দিয়েছে জনপদ। ৩৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি জলাধারও যে এমন ভঙ্গুর হতে পারে, সে ধারণা অনেকেরই ছিল না। ‘

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:৪৮
Share:

বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন কাহালগাঁওয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। ছবি: ফেসবুকের সৌজন্যে।

কোথাও কোনও বড় বিপর্যয় ঘটলে কী হয়? সর্বাগ্রে বিপর্যয়ের মোকাবিলা হয় নিশ্চয়ই। সভ্য দুনিয়ায় অন্তত তেমনই হওয়া উচিত। তার পরে অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়, তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হয়। সব শেষে বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়—এমন বিপর্যয় যাতে আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়। কিন্তু এ সব সম্ভবত অন্য দেশে হয়, আমাদের দেশে নয়। এ দেশে বিপর্যয়ের পর সর্বাগ্রে চাপান-উতোর হয়। অত্যন্ত দ্রুত দোষ ঝেড়ে ফেলা এবং অন্যের উপর তা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ কিছুতেই বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করতে চান না এ দেশে। ‘সুশাসন’-এর জয়ডঙ্কা বাজাতে অভ্যস্ত ‘নীতীশ কুমার ব্র্যান্ড’ও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়, বাঁধ ভাঙতেই স্পষ্ট হয়ে গেল সে কথা।

Advertisement

জলাধার ধসে গিয়েছে বিহারে, উদ্বোধনের ঠিক আগের দিন ঘটেছে বিপর্যয়, বাঁধ-ভাঙা হু হু প্লাবন ভাসিয়ে দিয়েছে জনপদ। ৩৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি জলাধারও যে এমন ভঙ্গুর হতে পারে, সে ধারণা অনেকেরই ছিল না। ‘সুশাসন বাবু’ ডাকনাম যে নীতীশ কুমারের, তাঁর রাজত্বেও যে এমন ঘটতে পারে, সে ধারণাও এত দিনে অনেকেরই ছিল না। তবে ধারণা কী ছিল, আর কী হল, তা নিয়ে সম্ভবত নীতীশ কুমার তেমন মাথা ঘামাচ্ছেন না। নীতীশের প্রশাসন এখন দায় ঝাড়তেই ব্যস্ত। জলাধারের যে অংশ আগে তৈরি হয়েছিল, ভেঙে পড়েছে সেই অংশই, নতুন অংশ থেকে বিপর্যয় ঘটেনি—বলছেন নীতীশের জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী।

আরও পড়ুন: উদ্বোধনের আগের দিন বাঁধ ভাঙল ভাগলপুরে

Advertisement

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিহারের রাজ্যপাট নীতীশ কুমারের করায়ত্ত। জলাধার ভেঙে বিপর্যয় আসার পর নীতীশের প্রশাসন তা হলে ঠিক কী বলতে চাইছে? এই এক দশকে সম্পূর্ণ বিহারের ভাল-মন্দের দায়-দায়িত্ব নীতীশ কুমার ছিল না, যা কিছু ‘নতুন’ হয়েছে রাজ্যে, শুধু সেটুকুরই দায় নীতীশ কুমারের, এমনই কি বলতে চাইছে? উত্তরপ্রদেশের হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর মিছিলের পর যোগী আদিত্যনাথের অনুগামীরা তা হলে কি বলবেন? ওই হাসপাতাল যোগীজির আমলে তৈরি নয়, এমনটাই বলবেন নিশ্চয়ই। রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলায় আদালতের রায়কে ঘিরে হরিয়ানায় তুমুল হিংসা ছড়ানোর পর মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর তা হলে কী করবেন? পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল যারা, কোন সরকারের আমলে তাদের জন্ম, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেবেন নিশ্চয়ই।

হাস্যকর চাপান-উতোর শুরু হয়েছে বিহারে। নীতীশ শিবির দায় ঝাড়ছে। লালু শিবির দায় চাপাচ্ছে। কিন্তু যে সেচ প্রকল্পের জলাধার ভাঙার পর এই নির্লজ্জ চাপান-উতোর শুরু হল, সেই সেচ প্রকল্প তো হাতে নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৭ সালে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে লালু নিজেও তো ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘকাল। দায় একা নীতীশের হবে কী করে?

জলাধার ভেঙে যে বিপর্যয় ঘটেছে বিহারে, তার চেয়েও বড় বিপর্যয় কিন্তু রয়ে গিয়েছে নেপথ্যে। সেচ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ৪০ বছর লেগে যাওয়া বিপর্যয়ের চেয়ে কম কী? ৩৮৯ কোটি টাকা ঢালার পরও জলাধার মজবুত করে গড়তে না পারা বিপর্যয়ের চেয়ে কম কী? আর এই সুদীর্ঘ সময়ে যাঁরা বিহারের মসনদ সামলেছেন, জলাধার বিপর্যয়ের পর তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই দায়মুক্ত হওয়ার নির্লজ্জ চেষ্টা বিপর্যয়ের চেয়ে কম কী?

এত রকম বিপর্যয়ের বীজ বুকে নিয়ে নিত্য পথ চলে আমাদের গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্রে প্রায় সবাই ক্ষমতা চান, গুরুদায়িত্ব চান। কিন্তু দায়বদ্ধতা কেউ চান না। গণতন্ত্রের প্রত্যেক অংশীদার দায় এড়াতে ভালবাসেন এ দেশে। কোনও স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্র্রের দৃষ্টান্ত এ রকম হতে পারে না। এ ভাবে গণতন্ত্র সাবালক হতে পারে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন