সম্পাদকীয় ১

প্রতিপক্ষ

ক্ষমতায় আসিবামাত্র যে যে জিনিস তাঁহার অপছন্দ, সেগুলিতে পত্রপাঠ ইতি টানিয়াছেন, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিবার জটিলতা দেখান নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৪
Share:

প্রথম বার্ষিকীতে পৌঁছাইয়া আর তবে সন্দেহ রাখিবার জায়গা নাই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনও সাধারণ প্রেসিডেন্ট নহেন, সাধারণ মাপের মানুষও নহেন। তিনি যে ভাবে বিশ্বপৃথিবীকে দেখেন (কিংবা দেখেন না), তাহার সঙ্গে কেবল একটিই তুলনা টানা যায়। তাঁহার দৃষ্টি শিশুর দৃষ্টি। বিরাট শিশুর মতো তিনি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দেশটির উচ্চতম পদটিতে বসিয়া শাসনকাজ চালাইতেছেন। ক্ষমতায় আসিবামাত্র যে যে জিনিস তাঁহার অপছন্দ, সেগুলিতে পত্রপাঠ ইতি টানিয়াছেন, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিবার জটিলতা দেখান নাই। প্যারিস চুক্তিতে তাঁহার আপত্তি নির্বাচনী প্রচারপর্বেই জানা গিয়াছিল, কিন্তু আপত্তি বলিয়াই চুক্তিটি হইতে তিনি এক কথায় বাহির হইয়া আসিলেন! কৃষ্ণাঙ্গদের তাঁহার পছন্দ হয় না, তাই আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দেশগুলিকে কুৎসিত ভাষায় বর্ণনা করিলেন। ইজরায়েলের প্রতি তাঁহার পক্ষপাত, তাই কোনও কূট রীতি নীতি ইতিহাস ভূগোলের ধার না ধারিয়া জেরুসালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী বলিয়া ঘোষণা করিলেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে ইরানকে ‘গুন্ডা দেশ’ নাম দিলেন, উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং-উনকে ‘রকেট-ম্যান’ বলিলেন। কিম জং-উন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে পরমাণু-হুংকার দিলে ট্রাম্প উলটাইয়া আরও বড় বোতাম টিপিবার প্রতিহুংকার দিলেন। তাঁহার সমালোচনা হইতেছে বলিয়া প্রচারমাধ্যমকে লাগাতার ধমক দিতে লাগিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এবং এফবিআই ডিরেক্টরকে কর্মরত অবস্থায় পদ হইতে বহিষ্কার করিলেন। সব মিলাইয়া এক বৎসরেই তিনি বুঝাইয়া দিলেন, গণতান্ত্রিক দেশের যাহা যাহা করিতে নাই, সে সব কিছুই করিতে, এবং অবলীলায় করিতে তিনি অতি উৎসুক। তিনি আর যাহাই হউন, ‘সাধারণ’ নহেন।

Advertisement

এই এক বৎসর ইহাও বুঝাইয়া দিয়াছে যে অবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতি দিন প্রেসিডেন্টের নূতন নূতন কাণ্ডকারখানার আলোচনা, সমালোচনা, রম্যালোচনা করিয়া যাওয়ার কাজটি মনোগ্রাহী হইতে পারে, কিন্তু তাহা কোনও সমাধানের সূত্র দেয় না। শত সমালোচনার মধ্যে এইটুকু কৃতিত্ব তাঁহাকে দিতেই হইবে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারে নিজেকে ভিন্ন রকম প্রমাণের চেষ্টা করেন নাই, তিনি যেমন, তেমন ভাবেই আসিয়াছিলেন, কোনও অতিরিক্ত সাজ ছাড়াই। মার্কিন জনসমাজের রায়ে তিনি যখন ক্ষমতায় আসীন হইয়াছেন, তখন তিনি নিজের প্রতিশ্রুতিগুলিই একের পর এক রাখিবার প্রয়াস করিয়াছেন। বাস্তবিক, অনেক নেতাই প্রচারে আসিয়া অনেক কথা বলিয়া যান এবং পরবর্তী কালে ক্ষমতায় আসিয়া বেমালুম ভুলিয়া যান। ট্রাম্প কিন্তু ব্যতিক্রমী, ওই দলে পড়েন না। তিনি তাঁহার সমর্থককুলকে এক বিন্দু হতাশ করেন নাই। মেক্সিকো আর আমেরিকার সীমান্তে দেওয়াল যে এখনও গাঁথা হয় নাই, তাহা তাঁহার দোষ নহে, তিনি সব রকম চেষ্টা করিয়া যাইতেছেন। তাঁহার কথার মাথামুণ্ড খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর হইতে পারে, কিন্তু তাঁহার যেমন কথা তেমনই কাজ।

অর্থটি সহজ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গণতন্ত্রের মাধ্যমেই আমেরিকা শাসনের দায়িত্ব পাইয়াছেন, সুতরাং গণতান্ত্রিক সমাজকেই ভাবিতে হইবে, কী ভাবে তাঁহাকে প্রতিহত করা যায়, অথবা আদৌ করা যায় কি না। মার্কিন দেশের এবং সেই সূত্রে গোটা বিশ্বের, গণতন্ত্র এখন ট্রাম্প নামক বিরাট পরীক্ষার সামনাসামনি। যে প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্রের ব্যবস্থার মধ্য দিয়া আসিয়া ব্যবস্থাকে গুঁড়াইয়া দিতে উদ্যত হন, তাঁহাকে লইয়া কী করণীয়, ‘ব্যবস্থা’কেই তাহা স্থির করিতে হইবে। অনেক সময় চরম পরীক্ষার সামনে পড়িয়া লড়াকু সত্তাটি জাগরূক হইয়া উঠে, চ্যালেঞ্জের সামনেই তৈরি হয় সত্যকারের প্রতি-চ্যালেঞ্জ। ট্রাম্পের কার্যক্রম দেখিতে দেখিতে এখন এই আশাটিই আঁকড়াইয়া ধরিতে হয়: গণতন্ত্র হয়তো এই ধাক্কায় লোপ না পাইয়া নব-উত্থান সম্ভাবিত করিবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন