একাকী: সুনামির (২০০৪) পর ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ। এএফপি
আন্দামানের নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের হাতে মার্কিন ধর্মপ্রচারক জন অ্যালেন চাউয়ের মৃত্যু সংবাদ বিশ্ব জুড়ে যতটা সাড়া ফেলেছিল, তার কয়েক মাস আগের একটি সরকারি নির্দেশ কিন্তু পরিবেশ আন্দোলনকারীদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির বাইরে বিশেষ চাউর হয়নি। গত অগস্ট মাসের গোড়ায় ভারত সরকার হঠাৎই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ২৯টি দ্বীপকে নিয়ন্ত্রিত এলাকার জন্য বিশেষ অনুমতির আওতার বাইরে নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য, এই অঞ্চলে পর্যটনের প্রসার। মুশকিল হল, এই ২৯টি দ্বীপের মধ্যে আছে আন্দামানের নর্থ সেন্টিনেল, স্ট্রেট ও লিটল আন্দামান— তিনটিই ‘বিশেষ ভাবে বিপন্ন জনজাতীয় গোষ্ঠী’ (পিটিভিজি) সেন্টিনেলিজ়, গ্রেট আন্দামানিজ় ও ওঙ্গি অধ্যুষিত। আছে নিকোবরিজ়দের বাসভূমি অনেকগুলি দ্বীপও। অর্থাৎ জনজাতীয় পর্যটনের উপর সরকার যে জোর দিতে চাইছে তাতে সন্দেহ নেই। পর্যটনে উৎসাহ অর্থনীতির পক্ষে ভালই হওয়ার কথা। কিন্তু আন্দামানের যে সব আদিম জনজাতি আজ বিলুপ্তির পথে, তাদের বাসভূমিতে অবাধে পর্যটক আসতে দিলে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। চাউয়ের ঘটনা তাই ব্যতিক্রমী নয়, নেহাতই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার সত্তর বছর পেরিয়েও যে দেশে জনজাতীয়দের জন্য কোনও জাতীয় নীতি গড়ে ওঠে না, সেখানে তো এটাই হওয়ার কথা।
মানুষকে নিয়ে চিড়িয়াখানা তৈরির সূচনা অবশ্য ঔপনিবেশিক যুগেই। দেশে তখনও কোম্পানি-রাজ। ১৮৫৭ সাল শেষ হতে চলেছে, সিপাহি বিদ্রোহের বড় ধাক্কা মোটের উপর সামলে নিয়েছে ব্রিটিশ ফৌজ। ২৩ নভেম্বর কলকাতা থেকে ছাড়ল স্টিম ফ্রিগেট ‘সেমিরামিস’, গন্তব্য মৌলমিন। সেখান থেকে ফৌজি স্টিমার ‘প্লুটো’য় যাত্রা শুরু হল অভিযাত্রীদের, লক্ষ্য আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। আন্দামান কেন? ১৭৮৮তেই তো কর্নওয়ালিসের উদ্যোগে আন্দামানে উপনিবেশের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির জন্য কয়েক বছরের মধ্যেই পাততাড়ি গোটাতে হয়। না, এ বার উদ্দেশ্য অন্য। ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে বা তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়ার পরেও বন্দি সেপাইদের সংখ্যা তো কম নয়, তাদের দেশে রাখা বিপজ্জনক। কালাপানি পার করে আন্দামানে পাঠিয়ে দেওয়াই সব থেকে ভাল।
এই সমীক্ষা পর্বে আন্দামানের বিভিন্ন দ্বীপে আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে বার বার টক্কর লেগেছে অভিযাত্রীদের, ‘সভ্য’ মানুষরা কোথাও সাদর অভ্যর্থনা পাননি। কয়েক বার প্রাণ বাঁচাতে গুলিও চালাতে হয়েছে, সবই নাকি মাথার উপর দিয়ে। অভিযানের নেতা এফ জে মোয়াট নির্দ্বিধায় লেখেন, আন্দামানের অধিবাসীরা বুনো, অসভ্য। অচেনা মানুষকে তারা শত্রু ভাবে, আশ্রয় তো দেয়ই না। বর্বরতার অতল গহ্বরে তারা পড়ে আছে। সভ্যতার মাপকাঠিতে তাদের থেকে নিচু স্তরে কাউকে ভাবাই অসম্ভব। তবে তারা নরমাংসভোজী নয়, এটুকুই বাঁচোয়া। এমন মানুষের একটি ‘নমুনা’ মোয়াট নিয়ে আসেন কলকাতায়, ইন্টারভিউ আইল্যান্ডে ধৃত বছর পঁচিশের এক যুবক। তাকে জামাকাপড় পরানো হয়, নানা রকম খাবারও দেওয়া হয়। সে এতটাই ‘সভ্য’ হয়ে উঠছিল যে জামাকাপড় খুলে ছবি তুলতে খুব আপত্তি করেছিল। কিন্তু কলকাতার আবহাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে আবার সেই দ্বীপেই জন্মদিনের পোশাকে ফেরত পাঠানো হয়, তার পর তার কী হয়েছিল কেউ খবর রাখেনি।
‘সভ্য’ সমাজে ‘অসভ্য’দের প্রদর্শনের তো সেই শুরু। আর সভ্যতার সংস্পর্শে এসে অসভ্যদের অবলুপ্তির সূচনাও তখন থেকেই। ১৮৮৩-র জুলাই মাসে আন্দামান থেকে জনজাতীয় চার জন পুরুষ ও দু’জন নারীকে ফের কলকাতায় পাঠানো হল। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পাঠানোর জন্য তাদের দেখে মডেল তৈরি করা হবে। কলকাতায় কয়েক সপ্তাহ তাদের রাখা হল আলিপুর চিড়িয়াখানায়। সেখানে তাদের দেখতে নাকি বাঙালিদের লাইন পড়ে গিয়েছিল, কারণ এর আগে তারা তো ‘রাক্ষস’দের কোনও বংশধরকে দেখেনি! অন্তত এমনটাই লিখে গিয়েছেন আন্দামান-বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড হোরেস ম্যান (১৮৮৫)। তবে তার মধ্যে আন্দামানের আদিম অধিবাসীদের ‘সভ্য’ করার জন্য কম চেষ্টা করেননি উপনিবেশের প্রভুরা। দ্বীপগুলি ছিল ওদের নিশ্চিন্ত বিচরণভূমি, কত হাজার বছর ধরে কে জানে। আফ্রিকার মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেগ্রিটোরা কবে এই সব দ্বীপের বাসিন্দা হল, বহির্জগৎ থেকে আলাদা হয়ে শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবেই কত কাল থেকে গেল, তার পাথুরে প্রমাণ আজও মেলেনি। কিন্তু উপনিবেশ গড়ার পরের একশো বছরের মধ্যে কর্তৃপক্ষের যাবতীয় ‘সদিচ্ছা’ সত্ত্বেও তারা যে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রথমে ছিল তির-ধনুক নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা। অন্য দিকে কামান-বন্দুক দিয়ে ‘আত্মরক্ষা’র উদ্যোগ। ফলে যা সর্বত্র হয়েছে, এখানেও কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৮৫৯-এ অ্যাবার্ডিনের যুদ্ধে গ্রেট আন্দামানিজ় জনজাতির ব্যাপক ক্ষতি হয়, এর পর আর তারা আক্রমণে যায়নি। তাদের জন্য তৈরি হল ‘আন্দামানিজ় হোম’, নিখরচায় খাওয়া পরার বন্দোবস্ত। কিন্তু কোনও দিক থেকেই তাদের কোনও উপকার হল না, আবাসভূমি হারিয়ে অভ্যস্ত জীবন যেমন এলোমেলো হয়ে গেল, জুটল নানা নেশা, আর তেমনই প্রতিরোধক্ষমতা না থাকায় নতুন নতুন রোগের মহামারিতে তারা উজাড় হয়ে গেল। সিফিলিস, গনোরিয়ার মতো যৌনরোগের সঙ্গে এল হাম, মাম্পস, ইনফ্লুয়েঞ্জা। ১৮৫৮-র ৩৫০০ জনসংখ্যা ১৯৩১-এ ঠেকল ৯০তে।
উপনিবেশের এই ছবি তো সারা পৃথিবী জুড়ে একই। তা হলে আবার সবিস্তারে সেই যন্ত্রণা দুঃখ হাহাকার কেন? স্বাধীনতার পর তো ছবিটা পাল্টানোর কথা। নেহরুর পঞ্চশীল থেকে শুরু করে জনজাতীয়দের জন্য কত ব্যবস্থা হয়েছে, আন্দামানে বিশেষ বিধি বলবৎ হয়েছে। গ্রেট আন্দামানিজ়, ওঙ্গি, জারোয়া, সেন্টিনেলিজ়দের ‘বিশেষ ভাবে বিপন্ন জনজাতীয় গোষ্ঠী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ওঙ্গি, জারোয়াদের সঙ্গেও মোটের উপর সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এতে তো ভালই হওয়ার কথা। ‘স্বাভাবিক’ জীবনে নিয়ে আসা, শিক্ষাদীক্ষা, স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা করা, চাষবাসের দিকে মতি ফেরানো এ সব তো ওদের ভালর জন্যই করা। কিন্তু তাতে এমন উল্টো ফল হল কেন? ১৯৭০ নাগাদ গ্রেট আন্দামানিজ় জনজাতির শেষ ২৮ জন মানুষকে আন্দামানের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে স্ট্রেট আইল্যান্ডে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। ২০০১-এর জনগণনায় তাদের সংখ্যা ৪৩। সরকারি অনুদানের উপর নির্ভরশীল এই মানুষগুলির নিজস্ব ভাষাও আজ প্রায় লুপ্ত। ১৯৬৭ পর্যন্ত ওঙ্গিদের বাসস্থান ছিল লিটল আন্দামান জুড়ে। এই সময় থেকেই শুরু হল লিটল আন্দামানে বাঙালি তথা ভারতীয়দের নতুন করে উপনিবেশ গড়া। নিকোবরিজ় জনজাতীয়দেরও নিয়ে আসা হল সেখানে। শুরু হল ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজকর্ম। জঙ্গল কেটে ফেলা, চাষবাস আর বাগিচা তৈরির জেরে ওঙ্গিরা আস্তে আস্তে নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ল। ১৯০১-এ ৬৭১ থেকে তারা ৯৬-এ ঠেকেছে ২০০১-এ। সংক্রামক রোগ এখানেও একটা বড় কারণ। নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে এখন তারাও সরকারের উপর নির্ভরশীল অসহায় জনসমষ্টিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৪ পর্যন্ত জারোয়ারা দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামানের বিস্তীর্ণ অংশে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। কখনও প্রতিরোধ, কখনও আত্মরক্ষা, নানা ভাবে। ঔপনিবেশিক পর্বে বহু আক্রমণ চলেছে তাদের এলাকায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমায় বিধ্বস্ত হয়েছে তাদের বাসভূমি। ক্রমশ বসবাসের এলাকা সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে, চিরাচরিত খাদ্য সংগ্রহের পদ্ধতি হয়ে গিয়েছে অকেজো। ১৯৭৪-এর পর জারোয়ারা কিছুটা আকস্মিক ভাবেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দিকে ঝুঁকেছে। জারোয়া রিজ়ার্ভের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড। সেই পথে এখন নিয়মিত ভিড় পর্যটকদের। ‘হিউম্যান সাফারি’! এও তো সেই চিড়িয়াখানাই হল। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও বাইরের মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগের ঘটনা ঘটছেই। জারোয়াদের সংখ্যা এখন আড়াইশোর কাছাকাছি, কিন্তু ভবিষ্যৎ নিতান্ত অনিশ্চিত। ‘সহৃদয়’ ভাবে রক্ষা করতে গিয়ে স্বাধীন দেশেও তো আমরা পৃথিবীর অন্যতম আদিম এই ক’টি মানবগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না!
টিকে গিয়েছে শুধু নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের অধিবাসীরা— যারা দ্বীপের নামেই সেন্টিনেলিজ় বলে পরিচিত। সংখ্যায় হয়তো জনা চল্লিশ। বাইরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই তাদের। পৃথিবীতে তারাই নাকি তথাকথিত সভ্যতার সংস্পর্শবিহীন একমাত্র আদিম মানুষ যারা এখনও নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কাছাকাছি কাউকে আসতে দেখলেই তির ছুড়ে তারা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তাদের দ্বীপে কেউ কখনও পা দেয়নি এমন অবশ্য নয়। উনিশ শতকে আন্দামানের প্রশাসক মরিস ভিডাল পোর্টম্যান বিশাল দলবল নিয়ে সে দ্বীপে হানা দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে নৃতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ত্রিলোকীনাথ পণ্ডিত অনেক বার সেন্টিনেলিজ়দের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। দ্বীপের ভিতরে গিয়ে তাদের সম্পর্কে কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেন। বস্তুত সেই তথ্যই আজও নৃতত্ত্ববিদদের সম্বল। পরে নৃতত্ত্বের গবেষক মধুমালা চট্টোপাধ্যায়ও এক বার কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই সেন্টিনেলিজ়দের হাতে নারকেল তুলে দিতে পেরেছিলেন। কেন কে জানে, তেমন চেষ্টা পরে আর হয়নি। হয়তো ভালই হয়েছে। কিন্তু এ বার? প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল আর তার মুষ্টিমেয় বাসিন্দা কি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রবল উৎসাহ থেকে রক্ষা পাবে?