যোদ্ধাদের ভয় পেতে নেই, তা হলে তাঁরা খাটো হয়ে যাবেন যে!

ভয়ের ওঁরা, ভয়ের আমরা

সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গ্রেফতার করেছে। ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান-এর রক্তাক্ত মুখের ছবি দেখতে দেখতে পৌঁছে গিয়েছে গোটা দেশের মানুষের ঘরে ঘরে।

Advertisement

কৌশিক সেন

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ০০:১০
Share:

সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গ্রেফতার করেছে। ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান-এর রক্তাক্ত মুখের ছবি দেখতে দেখতে পৌঁছে গিয়েছে গোটা দেশের মানুষের ঘরে ঘরে। জেনিভা চুক্তির শর্ত, ভারতের দাবি, পাকিস্তানের পাল্টা বার্তা, ভারতের কোটি কোটি মানুষের উদ্বেগ, শুভকামনা, প্রার্থনা, সব পার হয়ে নিছক এক জন মানুষ হিসেবে সেই মুহূর্তগুলিতে জানতে, বুঝতে ইচ্ছে করছিল— কী চলছে ওই বন্দি মানুষটির মনের ভিতরে? বছরের পর বছর কঠোর নিয়মানুবর্তিতায়, নিষ্ঠায়, প্রশিক্ষণে, দেশপ্রেমে, কোনও সন্দেহ নেই, অকুতোভয় তিনি। তবু, রাত্রি যখন গভীর, নিস্তব্ধ, সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধকে সেলাম জানিয়ে গর্বিত কোটি দেশপ্রেমিক ‘আমরা’ পেট ভরে খাবারদাবার খেয়ে যখন নিশ্চিন্ত ঘুমের দেশে পা বাড়িয়েছি, তখন কেবলই মনে হচ্ছিল, সীমান্তের ও পারে ওই মানুষটি ঠিক কী ভাবছেন।

Advertisement

বিনয়পিটক-এর মহাবর্গ গ্রন্থে এক আশ্চর্য কাহিনি আছে। মগধের রাজা বিম্বিসারের রাজত্বকালে কয়েক জন খুব বিখ্যাত যোদ্ধা, হত্যা করে ক্লান্ত হয়ে, পাপকর্ম থেকে বিরত হওয়ার জন্য বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কোনও লোভ বা ভীরুতা থেকে নয়, সেই বীর যোদ্ধারা রক্ততৃষ্ণা থেকে সরে এসে নিজেদের কল্যাণকর্মে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজা-মহামাত্যবর্গ ও সেনানায়করা সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলেন না। বীর যোদ্ধারা যদি হত্যা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় তবে তো সিংহাসন টলে যাবে। অগত্যা রাজা বুদ্ধদেবের শরণাপন্ন হলেন। রাজার নিবেদনে সাড়া দিয়ে বুদ্ধদেব সমস্ত রাজসৈন্যের প্রব্রজ্যা গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দিলেন। যিনি প্রচার করতেন প্রাণহানি অন্যায়, যিনি যজ্ঞে পশুহত্যায় আপত্তি জানিয়েছিলেন, সেই বুদ্ধদেব নরহত্যা না করতে চাওয়া যোদ্ধাদের আশ্রয় দিলেন না। কারণ তাতে রাজকার্য ব্যাহত হত। সৈন্য ছাড়া শাসন হয় না। শাসনের ওপরই টিকে থাকে শাসকের অস্তিত্ব।

তাই বীরযোদ্ধাদের ভয় পাওয়া নিষিদ্ধ। আমাদের দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, বা বলা ভাল গোটা পৃথিবীর ইতিহাসের বিভিন্ন ভাঙাগড়ায় তাঁদের আত্মবলিদান, তাঁদের নির্ভীক মুখগুলোই যেন একমাত্র পরিচয়। তাঁদের মানুষ ভাবাটা যেন অন্যায়, যেন মানুষ ভাবলে তাঁরা খাটো হয়ে যাবেন। তাঁরা বীর, তাঁরা নির্ভয়।

Advertisement

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক ফুরেদি-র লেখা হাউ ফিয়ার ওয়ার্কস: কালচার অব ফিয়ার ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি বইটিতে দেখি, কী ভাবে যুগে যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান বা নিয়ন্ত্রকরা তাঁদের সেনাবাহিনীর মন থেকে ভয় উপড়ে ফেলতে চেয়েছেন। ইতিহাস বলছে, কখনও কোনও এক দেশ বা জাত তাদের নিজেদের যোদ্ধাদের উৎসাহিত করেছে এই বলে যে, ‘‘প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনীকে দেখে ভীত বা আতঙ্কিত হোয়ো না, কারণ আমাদের ভগবান ওদের ভগবানের চেয়েও শক্তিমান...’’ আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যেক প্রাশিয়ান পদাতিক সৈন্য যুদ্ধের আগে সমস্বরে চিৎকার করে বলতেন, ‘‘গট মিট উন্‌স’’— ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন। অর্থাৎ যাঁদের সঙ্গে ঈশ্বর আছেন, তাঁদের আর কিসের ভয়?

সেই কোন সুদূর অতীতে, প্লেটো, সক্রেতিস-এর বিভিন্ন লেখায়, ভাবনায় উঠে এসেছে, কী ভাবে যোদ্ধারা মৃত্যুভয়কে জয় করবে। এমনকি হোমার-এর অসামান্য বর্ণনায় মৃত্যুর পর যে অতলস্পর্শী নরকের কথা আছে, সেই বর্ণনাকে বাতিল করতে উৎসাহিত হয়েছিলেন সক্রেতিস। কারণ তাঁর মতে ওই নরকের বর্ণনা মানুষকে ভীত করে তুলবে, যোদ্ধারা মৃত্যুবরণ করতে ভয় পাবেন। তাই এমন কাহিনি, এমন সমস্ত বীরগাথা তৈরি করো, যার ছত্রে ছত্রে থাকবে সাহস, ভয়কে জয় করবার মন্ত্র, যাতে সৈনিকরা মরতে পারেন হাসিমুখে। সক্রেতিস এমন পরামর্শও দিয়েছেন যে প্রকাশ্যে শোকজ্ঞাপনও বন্ধ করা হোক, কারণ কোনও বীরের মৃত্যুতে জনসমক্ষে শোকজ্ঞাপন করলে তা হবে দুর্বলতারই নামান্তর। বিশেষ করে পুরুষের তো তা একেবারেই পরিহার করা উচিত, ও কাজ বরং মহিলাদের জন্যই তোলা থাক— এমনটাই মনে করতেন সেই প্রাজ্ঞ দার্শনিক। ঊনবিংশ শতাব্দীর অর্ধেকেরও বেশি সময় জুড়ে সেনাবাহিনী তাদের বীর সেনাদের এমন শিক্ষা দিয়েছে বা এমন ভাবে তৈরি করেছে, যেখানে মৃত্যুভীতি অতি ঘৃণ্য এক ভীরুতার সমতুল্য।

তবু বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ভয়ের কবল থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে রাখা গেল না।

১৯০৪-০৫’এর রাশিয়া-জাপান যুদ্ধ, ১৯১২’র বলকান যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ভয়াবহতা সামরিক মনোবিজ্ঞান (মিলিটারি সাইকায়াট্রি) নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করল। ১৯১৮ সালের মধ্যে সামরিক মনোবিজ্ঞানের গবেষণা ও চর্চার একটা প্রধান বিষয় হয়ে উঠল ভয়। যে সম্মান একটা সময়ে বীরদের ভীত হওয়াকে মান্যতা দিত না, সেই অবস্থার বদল ঘটতে শুরু করল। দু’জন ব্রিটিশ নৌসেনা, বিল ওয়েক ও বিল নেস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (ঐতিহাসিক ডি ডে’তে) জার্মানি অধিকৃত ফ্রান্সের নরম্যান্ডি সমুদ্রতটের সেই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের স্মৃতি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘প্রত্যেকেই ছিল অসম্ভব ভীত, কিন্তু আমাদের মুখে সেই ভয়ের ছায়া পড়ত না। কারণ তা ছিল নিয়মবিরুদ্ধ ও রীতিবিরুদ্ধ এক নিষিদ্ধ আচরণ...’’

মনে পড়ে ১৯৯৫ সালের এক কাহিনি। বসনিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন বায়ুসেনার ক্যাপ্টেন স্কট ও’গ্রেডির প্লেনে আঘাত এসেছিল। শত্রুপক্ষের গোলা এবং সার্বিয়ান সেনাদের হাত এড়িয়ে, প্রাণ বাঁচিয়ে তিনি নিরাপদে অবতরণ করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রকাশ্যে বলেন, ‘‘সবাই বলছে, তুমি নায়ক, কিন্তু আসলে, ওই ভয়ানক সময়ে, আমি ছিলাম একটি খরগোশের মতো ভীত ও সন্ত্রস্ত, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ব্যাকুল।’’ অর্থাৎ ভয়কে অগ্রাহ্য করে নয়, ভয়কে স্বীকার করে ভয় সম্পর্কে প্রকাশ্যে বলার হিম্মত দেখিয়ে ভয়কে জয় করার এক নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।

আর আমরা? যারা বৃহত্তর সমাজে, প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে কারণে-অকারণে ভয়কে বুকে লালন করে বেঁচে আছি? যারা কেবলই দেশভক্তির বুলি কপচাই? ভয় সর্বত্র আমাদের তাড়া করছে। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, পাড়ায়, অফিসে, বাজারে, সংসারে— ছোটখাটো থেকে বৃহৎ— নানা রকম ভয় প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের। ক্ষমতা ও ক্ষমতাবানদের সম্পর্কে ভয়, তাঁদের ‘ঠিক মতো’ খুশি করতে সক্ষম হলাম কি না তার ভয়, অন্যায় দেখলেও প্রতিবাদ করতে ভয়।

এবং এই পাহাড়প্রমাণ রকমারি ভয় বুকে নিয়েই আমরা ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে যুদ্ধের হুঙ্কার তুলি। ‘যুদ্ধ চাই না’ বলছেন যাঁরা, তাঁদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করে এক জান্তব উন্মাদনায় মেতে উঠি। কেন এমন করি আমরা? ফ্র্যাঙ্ক ফুরেদি লিখেছেন, পৃথিবী জুড়ে ঈশ্বর-স্বর্গ-নরক ইত্যাদি নিয়ে যে ভীতি (বিশেষত পশ্চিমের দেশে), যে বিশ্বাস, তার একটা পরিবর্তন সুস্পষ্ট ভাবে লক্ষ করা গিয়েছে। ধর্ম নিয়ে, ঈশ্বর নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা সংশয় ও দৃষ্টিভঙ্গিগত বদল, এসেছে বৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তার ঢেউ— যা ভেঙে দিয়েছে ভয়ের চিরায়ত ধর্মীয় সংগঠনকে। ফলে ভয়ের চরিত্র গিয়েছে বদলে। ভয় এখন অসুখ। আমরা এখন ভয় পেতে ভয় পাই, লজ্জিত হই, মনস্তাত্ত্বিকের শরণাপন্ন হই।

নিজেদের এই লজ্জা ও দ্বিধা ঢাকার একটা সুবর্ণসুযোগ তৈরি হয়, যখন রাষ্ট্রনেতারা কোটি কোটি মানুষের দুঃখ, অনাহার, দারিদ্রকে দু’পাশে ঠেলে সরিয়ে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হন হিংসার দিকে। তখন কে প্রকৃত শত্রু তা আমরা বুঝতে পারি না। তখন শহিদের পরিবারের কেউ যখন নিজের সকল শোক ও দুঃখকে অতিক্রম করেও বলেন, যুদ্ধ চাই না, তাঁকেও আমরা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করি, সামাজিক মাধ্যমে বয়ে যায় নিন্দার ঝড়। দেশকে যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা খুব চতুর ভাবে, অত্যন্ত সচেতন ভাবে আমাদের দুর্বলতা ও ছোট-বড় ভীরুতাগুলোকে বুঝে নিয়ে আমাদের ভিতর জমে থাকা নানা না-বলতে-পারা প্রতিবাদগুলোকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হন এক অনিয়ন্ত্রিত, অবিবেচক, ভঙ্গুর, ফুলিয়েফাঁপিয়ে তোলা দেশপ্রেমের স্রোতে। ঠিক যেমনটি এখন হচ্ছে। এই ভয়-আড়াল-করা, ভয়-অস্বীকার-করা সংগঠিত দেশপ্রেমের তাড়নায় পুলওয়ামায় নিহত বীর যোদ্ধাদের সুরক্ষার প্রশ্নটাও কত সহজে ফিকে হয়ে গেল, কত সহজে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকরা পাল্টা আক্রমণ ও প্রতিশোধের পরিবেশ তৈরি করে নিজেদের ভুলগুলো ঢাকতে চাইলেন!

উগ্রপন্থীদের আশ্রয় দেওয়া পাকিস্তানের নেতৃত্বকে অন্তর থেকে ঘৃণা করব নিশ্চয়ই, জেহাদের নামে নিরীহ মানুষ মারার কুৎসিত প্রয়াসকে কাপুরুষতা হিসেবেই চিহ্নিত করব। সীমা পার করে জঙ্গি শিবির গুঁড়িয়ে দেওয়াকেও সেলাম করব, কিন্তু একই সঙ্গে যে বীর সৈনিকরা আমাদের সুরক্ষার জন্য সব কিছু বিসর্জন দেন, তাঁদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা যে সরকার দিতে পারে না, তাকেও ধিক্কার জানাব। দেশের মাটিকে পুজো করে আমাদের জওয়ানরা আমাদের জন্য রক্তপাত করছেন, এ যেমন গর্বের, তেমনই তো উৎকণ্ঠা এবং ভয়ের। তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের সুরক্ষার জন্য কতটুকু করতে পারছি আমরা? তাঁদের আত্মবিসর্জনকে শুধুমাত্র দূরত্ব থেকে সেলাম জানিয়ে যুদ্ধের জিগির তোলাটাই বরং ভীতিপ্রদ এবং অসুস্থ এক আচরণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন