হা রকিউলিসেও আছি, হাড়জিরজিরেতেও! ডিজিটাল গিরগিটির মতো কখন রং পালটাচ্ছি, কখন রং নাম্বারে প্রেম বিলোচ্ছি, তুই ধরতে ধরতে পিছলে যাব শতেক মাইল। জানুয়ারিতে যখন ক্ষমতায় এলাম, কী আমার বামপন্থী দাপট! প্রতিবাদকে কানখুশকির মতো ঘোরাতে ঘোরাতে বললাম, গ্রিস যত কাতেই পড়ুক, তবু আইএমএফ আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তালির কাছে হাত জোড় করে কদাপি ওঠবোস করবে না, কভি নেহি! কী হাততালি! হবেই। লোকে নিজের দেশের নামে তেজি টোনে আওড়ানো উঁচু বাক্য শুনতে হেভি ভালবাসে। যার এক আনা মুরোদ নেই, গামছা পরে বাড়িওলার কাছে হেঁ-হেঁ করে তেল বিলোয়, সে অবধি লোকাল ট্রেনের আড্ডায় রোয়াব নেয়, ‘আমি কিন্তু জম্পেশ জেদি, এক বার যা ঠিক করি তা করে ছাড়ি!’ আত্মসম্মানের নেশা বহুত কড়া নেশা। সেইটা উসকে, বাস্তব ড্রাগনদের পাত্তাই না দিয়ে, রূপকথার রাজপুত্তুরের আগমনী আমদানি করলুম। বাংলা গ্রুপ থিয়েটারে যেমন পরাজিতকে শেষ সিনে পড়িমরি জিতিয়ে দেওয়া হয় আর দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে, কারণ তাদের পেঁচোয় পাওয়া সত্তা তোল্লাই পেল, তেমনই গ্রিসের পাবলিক আমার গনগনে ডিনায়াল স্পাইরাল স্পর্ধা দেখে ফ্যান্টাসি যাপল, উই শ্যাল বাপ বাপ বলে ওভারকাম।
আমি কলার তুলে ধরাধামের মস্তানদের পটকান দিতে লাগলুম। ওরা প্রস্তাব দেয়, আর আমি মুখ বেঁকিয়ে চলে আসি। ওরা কতকটা হাঁ, কারণ দেউলিয়া লোক ইতনা রেলা পালছে কী করে রে বাবা! আসলে, আমি শিয়োর ছিলাম, গ্রিসকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে দেওয়া আর বেহালা থেকে সৌরভকে উঠিয়ে দেওয়া একই। ফিজিকালি না-মুমকিন। আরে বাবা, গ্রিস রে। পৃথিবীকে অলিম্পিক কে দিয়েছে? আমরা। জ্যামিতি কে দিয়েছে? পিথাগোরাস। ফাদার অব হিস্ট্রি কে? হেরোদোতাস। কী বললি? স্পিলবার্গ কী নিয়ে হিট হল, ডাইনোসরাস? তোর মতো গেধো যে এই চুটকিটা মেরে বেরিয়ে যাচ্ছে, তার মূলে যে বন্দোবস্ত, সেই ডেমোক্রেসিও এই গ্রহকে আমরাই দিয়েছি রে ব্যাটা। এই যে থার্ডক্লাস লোকেরা চাদ্দিকে থইথই ইতরোমোর উৎসব করছে, হাড়-অশিক্ষিতকেও সবাই সাষ্টাঙ্গ স্যালুট ঠুকছে স্রেফ সে ভোট পেয়ে গেছে বলে, এই ফুর্তির পেটেন্টও আমাদের। প্লেটো-আরিস্ততল না থাকলে সিধে কথাকে চৌষট্টি প্যাঁচ দেওয়া ব্যবসা সেমিনারে নামে? আর্কিমিদিস না থাকলে চৌবাচ্চায় চানের আরাম জন্মায়?
অবস্থা অবশ্য আমাদের অ্যায়সান খারাপ, ফার্স্ট পেজ রিপোর্টিংকেও গ্রিক ট্র্যাজেডি বলে আঁতেল ক্লাসে পড়িয়ে দেওয়া যায়। তবু শাগরেদদের বললাম, ভয় পাসনি, পাঁকের দাগ ফুলপ্যান্টে ঢেকে রাখ। দামামা বাজিয়ে দিলাম, ভোট হবে। আমার নাগরিক বন্ধুরাই বলুক, তারা কি চায়, এই পবিত্তর ভূমিতে চাবুক ঘোরাবে বিদিশি কিছু ভিলেন, আর সেই বেয়াদপগুলোর ইশারায় বাড়বে ট্যাক্স, তোতলাবে ব্যাংক, পস্তাবে পেনশন? বার বার বললাম, ‘না’ বলুন, ভাইবোনেরা। ‘না’ বলুন, মায়-বাপ। ব্যস, নাচতে নাচতে সবাই না-এর দিকে হেলে পড়লে। ফিদেল কাস্ত্রো অবধি আমায় চিঠি লিখে অভিনন্দন জানালেন। স্বাভাবিক, না-এর নটবর উনি। সব কথায় গোঁয়ারের মতো ‘না’ গেয়ে গেছেন বলে কমিউনিস্টরা তাঁকে পুজো করে আর কিউবানরা শাপান্ত। যাকগে, এ বার ওই ‘না’কে বগলদাবা করে আলোচনার টেবিলে গুটিগুটি বসলুম। গলা ঝেড়ে বললুম, ইয়ে, ভাই-বেরাদররা তো খুব খেরে আছে, এখন আপনারা দড়িদড়ার ফাঁস ঈষৎ আলগা দিন, সম্মানজনক শর্তটর্ত লিখুন। অ মা, শত্তুর দেখি ভালই তৈরি, ব্যাপক বৈরী! কিছুতে গলে না! কোটেশন ফিলজফি সেন্টিমেন্ট হিস্টিরিয়া উড়িয়ে দিয়ে, ডেবিট আর ক্রেডিট কষতে বসে! বিশেষ করে জার্মানির ওই মেয়ে-মক্কেলটা টেরিফিক তেএঁটে! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে সবাই মিলে কেমন সেম-সেম প্যাঁচে ফেলেছিল তা মনে করিয়ে দিলে বলে, হিস্ট্রি ছাড়ুন, অ্যাকাউন্টেন্সি ধরুন। পয়সা ফেলছি, বকলশ পাকড়ে উশুল করব। বেগতিক দেখে ভালই মিনমিন করতে লাগলুম, মুখে যদিও চও়ড়া একখান এলইডি হাসি। ফোটোগ্রাফার তো আর অর্থনীতি বোঝে না! তার পর, আগে যে-রকম প্রস্তাব পেয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বিচ্ছিরি, আর আমাদের পক্ষে অনেক শক্ত আর অপমানজনক প্রস্তাব নিয়ে, পার্লামেন্টে এলাম।
ব্রাইট হাসিটি হেসে বন্ধুদের বললাম, যখন পরাজয় খলু অনিবার্য, তখন তক্ক কি বুদ্ধির কার্য? বিপদে যে অর্ধেক ত্যাগ করে, সে পণ্ডিত। আর যে পুরোটাই ফেলে সুড়সুড় পালায়, সে জিনিয়াস। লেফ্ট বলে তো কিছু হয় না, ওর মানে লেফ্ট অব দ্য মিড্ল। তা, বাস বেয়াড়া ব্রেক কষলে লেফটিস্ট লোক চেপে চেপে ক্রমে মাঝখানে চলে আসবে না? রাইটেও হেলে পড়তে পারে, ক্ষতি কী? ইগো চুলোয় যাক, ওদের শর্ত মেনেমুনে আদেশ-খোঁয়াড়ে সেঁধিয়ে যাই চ। মানে, যে প্যাখনা কপচেছিলাম, তার একদম উলটো মনুমেন্টে লাফিয়ে চড়লাম। সবাই মহা উৎসাহে মেনে নিলে। না মেনে যাবে কোথা, খেতে পাবে না।
বেইমানি? আরে রোসো রোসো, গ্রিক দার্শনিক বলেছিলেন, এক নদীর জলে দু’বার চান করা যায় না। নদীও বদলায়, যে চান করছে সে-ও বদলায়। আমিই বা একই জঙ্গিপনায় নিজেকে বরাবর সেঁকব কেন? বরং আদর্শ পালটে পালটে নেব, ক্যাবিনেট বদলে নেব, বদরাগি অর্থমন্ত্রীও। জনগণকে বেমক্কা পালটে নিতে পারব কি না জানি না, কিন্তু কানকাটা ম্যাজিক দেখিয়ে ধাঁ রাখতে পারব ক’দিন। খেলতে নামব মোহনবাগানের হয়ে, খেলা শেষ হতে সবাই আঁক খেয়ে দেখবে, গতরে সেঁটে আছে ইস্টবেঙ্গলের জার্সি। জিতি আর হারি, ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফিটি নিয়ে যাবই!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়