সম্পাদকীয় ২

নেতা, না কি তপস্বী

ঘটনাচক্রে, দীর্ঘমেয়াদি ছাত্ররাই সব ছাত্র ইউনিয়নের দুঁদে নেতা। কিন্তু তাহাতে কী? পড়াশোনা করিলে কি রাজনীতি করা যায় না? অনেক দিন পড়াশোনা করিলে অনেক দিন রাজনীতিও করা যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৭ ০০:৩২
Share:

আজ টেনিদা থাকিলে তাঁহার কপালে দুঃখ ছিল। শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং আসরে নামিয়া বলিয়াছেন, কোনও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন লাগাতার ছাত্র হিসাবে থাকিয়া যাওয়া চলিবে না। আন্দাজ করা যায়, প্রতিবাদের ঝড় ঈশান কোণে ঘনাইতেছে, এহেন ‘অনাচার’ করিয়া মন্ত্রী পার পাইবেন না। টেনিদা বেচারি অন্য কোথাও যাইতে পারেন নাই বলিয়া বিদ্যালয়ে থাকিয়া যাইতেন, তাঁহার কথা আলাদা। কিন্তু আজকালকার দীর্ঘমেয়াদি ছাত্ররা তো থাকিতে চান বলিয়াই কলেজে থাকিয়া যান। ইহা তাঁহাদের কাছে একটি স্বেচ্ছাগৃহীত, প্রলোভনময় পথ। তাঁহাদের বয়ান অনুযায়ী, একের পর এক ভাষা শিখিয়া, বিষয় পাল্টাইয়া জ্ঞানের নিরন্তর অন্বেষণই তাঁহাদের আন্তরিক বাসনা। তাঁহারা পাঠজগতের এমন অতন্দ্র নাগরিক বলিয়াই তাঁহাদের নাম কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে খাতায় এমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করিয়া লয়। তা, পঠনপাঠন কি নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না? আজ মন্ত্রী আসিয়া সেই গণতান্ত্রিক জ্ঞানচর্চার অধিকার হনন করিলেই হইল? ২০১২ সালে বাংলায় এমএ পড়িয়াছেন বলিয়া কি কেহ ২০১৭ পর্যন্ত সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়িয়া থাকিয়া উর্দু পড়িতে পারেন না? মন্ত্রী হইয়াছেন বলিয়া কি তিনি মানুষকে শান্তিতে ছাত্রাবস্থাও পালন করিতে দিবেন না? মগের মুলুক না কি শিবঠাকুরের আপন দেশ?

Advertisement

ঘটনাচক্রে, দীর্ঘমেয়াদি ছাত্ররাই সব ছাত্র ইউনিয়নের দুঁদে নেতা। কিন্তু তাহাতে কী? পড়াশোনা করিলে কি রাজনীতি করা যায় না? অনেক দিন পড়াশোনা করিলে অনেক দিন রাজনীতিও করা যায়। ছাত্র ইউনিয়নে দীর্ঘ কাল থাকিবার কারণে যদি কিছু মৌরসিপাট্টা জন্মায়, তাহাও তো গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। মন্ত্রী কি প্রমাণ করিতে পারিবেন যে রাজনীতি করিবার উদ্দেশ্যেই ইঁহারা ছাত্র হইয়া বসিয়া আছেন? প্রমাণ করিতে পারিবেন কি যে, বিদ্যাপ্রীতিবশত ছাত্র হইয়া থাকিয়াছেন বলিয়াই ইঁহারা ঘটনাচক্রে রাজনীতি করিবার দীর্ঘ অবকাশ পাইতেছেন— এই বিপরীত যুক্তিটি ভুল? নূতন নিয়মেও তো তাঁহারা যথেষ্ট নিরাপদ। নূতন আইনমতে, ছাত্র হিসাবে নাম নথিভুক্ত থাকিলে তবেই যদি কলেজে ইউনিয়ন করিবার অধিকার মিলিবে। সেই শর্ত তো মিটিতেছে। শাসক দলের ছাত্র শাখার কর্মী হইলে ‘কিছু’ সুযোগসুবিধা মিলে, ‘কিছু’ ক্ষমতা, অর্থকড়িও মিলে। কিন্তু উদার জ্ঞানচর্চায় উৎসাহী বলিয়াই না এত সব সুযোগ প্রৌঢ় ছাত্রদল পাইতেছেন। অধ্যবসায়ের মূল্য বলিয়াও তো একটি বস্তু আছে!

শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির বাড়াবাড়ি কমাইতে চাহিলে তাঁহাকে আর একটু মাথা ঘামাইতে হইবে। রাজনৈতিক মৌরসিপাট্টা ভাঙিবার সদিচ্ছা যদি থাকে, তবে কলেজের নেতারা কাহারা, তাঁহারা কত দিনের ছাত্র, এ সব অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কলেজের বাহিরের যে বড় অভিভাবক রাজনৈতিক পার্টি, ছাত্র-প্রতিনিধিদের তাহারা কী কী ধরনের সুযোগসুবিধা, সুরক্ষা, অর্থসম্পদ ও বলভরসা দিতেছে, সে সব দেখা। সেগুলি যদি একই রকম থাকে, তবে আজকের নেতৃদলকে জোর করিয়া তাড়াইলেও অচিরে নূতন নেতারা ঘাঁটি গাড়িয়া বসিবেন। দরকার ওই ঘাঁটিটির গোড়াতেই কোপ মারা। ঘাঁটিস্থিত মানুষগুলি নেহাত আপতিক, এক দল গেলে আর এক দল আসিবে। শিক্ষামন্ত্রী, লক্ষ্য স্থির থাকিলে লক্ষ্যভেদের পন্থাটি লইয়া আর একটু ভাবুন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন